বিচারপ্রার্থীদের সেবা দিতে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন বছরখানেক ধরে একটি হেল্পলাইন নম্বর চালু করেছে। গত এক বছরে এই হেল্পলাইনে তিন হাজারের বেশি কল এসেছে। বেশির ভাগ কলের সমাধান দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তবে অভিযোগ রয়েছে, ছোটখাটো অভিযোগ বা সমস্যার সমাধান দ্রুত দিলেও বড় অভিযোগের সমাধানে ধীরগতি দেখা গেছে। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন বলছে, বড় অভিযোগ এলে সেগুলো যাচাই-বাছাই বা তদন্ত করতে হয়। এজন্য তাতে সময় লাগে।
তবে আইনাঙ্গনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা হেল্পলাইন মনিটরিংয়ের তাগিদ দিয়েছেন। তারা বলছেন, যেকোনো সমস্যার দ্রুত সমাধান দিতে না পারলে বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা বাড়বে না। উন্নত বিশ্বে দ্রুত সমাধান দেওয়ার নজির রয়েছে বলেও জানান তারা।
সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন বলছে, বিগত এক বছরে হেল্পলাইনে সারাদেশ থেকে আইনি সেবা পেয়েছেন তিন হাজার ৭২ জন বিচারপ্রার্থী। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে সুপ্রিম কোর্ট হেল্পলাইন চালু করা হয়। পাশাপাশি হেল্পলাইন নাম্বারে হোয়াটসঅ্যাপ, অনলাইন অ্যাপ ও ইমেইল সার্ভিসও চালু করা হয়েছে। গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশ থেকে আইনি পরামর্শ, মামলা সম্পর্কিত তথ্য ও অভিযোগ দাখিলসংক্রান্ত মোট তিন হাজার ৭২টি কল আসে।
শুধু আইনি পরামর্শ সেবা গ্রহণে সারাদেশ থেকে ১৬৬৮টি কল আসে, এছাড়া বিভিন্ন মামলার তথ্য জানতে চেয়ে ১১৫৭টি কল আসে। যার সব তথ্যই সেবাগ্রহীতাদের তাৎক্ষণিকভাবে দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও শাখার কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রধান বিচারপতি বরাবর সর্বমোট ৬১টি অভিযোগ আসে। অভিযোগগুলো বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের এখতিয়ার বহির্ভূত হওয়ায় হেল্পলাইন থেকে তাদের কী করণীয় সে বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়।
প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নির্দেশক্রমে সুপ্রিম কোর্ট বিভিন্ন অনিয়ম, ঘুষ, কাজে অবহেলা, বিলম্বে সেবাপ্রাপ্তি, অসদাচরণ সম্পর্কিত আট মাসে মোট ১৮৬টি অভিযোগ আসে। যার মধ্যে বিলম্বে আইনি সেবাপ্রাপ্তিসংক্রান্ত অভিযোগ ৯৬টি। যার সব সেবা নিশ্চিত করা হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জবাবদিহিতার মুখোমুখি করা হয়েছে।
অবশিষ্ট ৯০টি অভিযোগ বিভিন্ন অনিয়ম, ঘুষ, কাজে অবহেলা, অসদাচরণ সম্পর্কিত। যার মধ্যে, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকদের বিরুদ্ধে পাঁচটি, জেলা আদালতের বিচারকের বিরুদ্ধে ৩২টি, আপিল বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে একটি, হাইকোর্ট বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ছয়টি, জেলা আদালতের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ৩৭টি এবং আইনজীবীদের বিরুদ্ধে নয়টি অভিযোগ পাওয়া যায়। এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ইতোমধ্যে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের পাবলিক রিলেশন অফিসার শফিকুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ফাইল পাওয়া যাচ্ছে না অথবা কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী অনিয়ম করেছে, কেউ কাজে গাফিলতি করেছে- এরকম ক্ষেত্রে আমরা তাৎক্ষণিক সমাধান দিয়ে দিচ্ছি। আমাদের কাছে অভিযোগগুলো আসে মোবাইলের মাধ্যমে, হোয়াটস অ্যাপে, লিখিত আকারে, ই-মেইল বা কখনো কখনো সরাসরি। অভিযোগ এলে আমরা আমলে নিয়ে এগুলো সমাধান করে যাচ্ছি। ২০২৪ সাল থেকে এই হেল্প সেন্টার চালুর পর থেকে বিচারপ্রার্থীর সেবা দিয়ে যাচ্ছি।
বিচারক কর্মকর্তা কর্মচারীরা ঘুষ দুর্নীতিসহ বড় ধরনের অপরাধ করলে সেগুলো কীভাবে সমাধান করছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদি বিষয়গুলো সমাধান করতে সময় লাগছে। কারণ এগুলো তদন্ত করা হয়। তদন্ত করতে সময় লাগে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে সাজার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।
হেল্পলাইন মনিটরিং ও দ্রুত সমাধানের তাগিদ
তবে হেল্পলাইনকে কার্যকর করতে মনিটরিংয়ের পরামর্শ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টে নিয়মিত প্র্যাকটিসরত আইনজীবী ব্যারিস্টার সানজিদ সিদ্দিকী। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, সুপ্রিম কোর্টের হেল্পলাইন অবশ্যই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। আমাদের দেশের অনেকেই বিচারিক সেবা পান না। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসেন বিচার চাইতে। সেক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট থেকে বিচারপ্রার্থীরা চাহিদা অনুযায়ী সেবা পান না। এসব সেবা দিতে যারা দায়িত্বে থাকেন সেই কর্মকর্তারা অনৈতিক সুবিধা চান। কিন্তু অদৃশ্য কারণে সেবা দিতে বিলম্ব করেন তারা। বিচারপ্রার্থীদের অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য আলাদা ফোরাম থাকলে অবশ্যই ভালো হতো। আলাদা করে একজনকে দায়িত্ব দিতে হবে এ বিষয়গুলো সমাধান করতে। যাতে করে তিনি সরাসরি ব্যবস্থা নিতে পারেন। সেবা পেতে এরকম হেল্পলাইন অনেক সরকারি অফিসে থাকে। কিন্তু সেবা দেওয়ার বাস্তবতা ভিন্ন। সেবা দিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সক্ষমতা থাকতে হবে। অভিযোগ দায়ের করে দ্রুত সমাধান না হলে সেই হেল্পলাইনের দরকার কী?
এই আইনজীবী বলেন, আমরা ইংল্যান্ডে পড়ালেখা করেছি। সে দেশের বারের কিছু নিয়ম দেখেছি, যা বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন। এটা হচ্ছে বার স্ট্যান্ডার্ট বোর্ড, এই বোর্ডে কোনো ব্যারিস্টারের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ দায়ের করলে সেটি ফলোআপ রাখা হয় নিয়মিত। কিন্তু আমাদের দেশে এরকম অবস্থা বাস্তবায়ন করা কঠিন।

হেল্পলাইন সম্পর্কে জানেন না অনেক আইনজীবী এমনটা জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী মো. তানভীর আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা যারা নিয়মিত প্র্যাকটিস করি তারা হেল্পলাইন সম্পর্কে অনেকেই জানি না। হেল্পলাইন খুললেও বিচারপ্রার্থীদের সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন দেখি না। আপনার কাছ থেকে প্রথম শুনলাম। আদেশের কপি সঠিক সময়ে কমিনিকেট করা হয় না। সেটা হচ্ছে হাইকোর্ট থেকে জজ কোর্টে আদেশের কপি পাঠাতে বিলম্ব হয়। সঠিক সময়ে সুপ্রিম কোর্ট থেকে জজ কোর্টে যায় না। এতে করে কারাগারে থাকা আসামি বের হতে সময় লাগে। মক্কেলরা আমাদের বার বার ফোন দেন, আদেশ সঠিক সময়ে পাঠাতে। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা আমাদের সেই সুযোগ দিতে বিলম্ব করেন।
প্রায় এক যুগ ধরে সুপ্রিম কোর্টে কাজ করছেন শিক্ষানবিশ আল আমিন সরকার। তিনি ঢাকা মেইল বলেন, সুপ্রিম কোর্টে আমরা আগের চেয়ে মোটেও বেশি সেবা পাচ্ছি না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঘুষের পরিমাণও আরও বেড়ে গেছে। আগে হতো প্রকাশ্যে, এখন হয় গোপনে। গোপনে হওয়ার কারণে ঘুষের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। যেমনি অগে এফিডেভিট করার সময় দুই থেকে তিনশ টাকার মধ্যে হয়ে যেত। এখন ডেপোনেন্টকে সরাসরি কোর্টে আসতে বলা হয়। বিশাল লাইন ধরে সেবা নিতে হয়। কিন্তু বড় অংকের অর্থিক সুবিধা দিলে সে কাজটি দ্রুত এবং হাতে হাতে হয়। তার মানে আগের চেয়ে ঘুষের পরিমাণ কয়েক গুণ বেড়েছে। এতে ভোগান্তি আরও বেড়েছে, কমেনি।
তিনি বলেন, আগে ফাইল বের করতাম ৩০ টাকা দিয়ে। এখন সেটি দাঁড়িয়েছে ১০০ থেকে ২০০ টাকা। কখনো কখনো ৫০০ থেকে এক হাজার টাকাও গুনতে হয়। আদেশ হলে সেটি টাইপ করার জন্য ৫০০ টাকা দিতাম আগে। এখন দ্রুত করতে ক্ষেত্র বিশেষে পাঁচ হাজার টাকাও দিতে হয়। ঈদ-অবকাশের ভিড় বা চাপ বেশি থাকলে একটি ফাইলের অর্ডার পাঠাতে নরমালি খরচের কয়েক গুণ বেশি ঘুষ দিতে হয়। না হলে অর্ডার ছাড়া হয় না। যারা বেশি টাকা খরচ করে তাদের আদেশের কপি যায়। কম করলে আদেশ যায় না। আমার একটা মামলার আদেশের কপি দেরিতে পাঠানোর কারণে ১১ দিন মক্কেল জেলে ছিল।
“সুত্র: ঢাকামেইল অনলাইন”