Home » শতকোটির সরকারি জমি সাড়ে পাঁচ লাখে বিক্রি

শতকোটির সরকারি জমি সাড়ে পাঁচ লাখে বিক্রি

0 মন্তব্য গুলি 2 জন দেখেছে 4 মিনিট পড়েছেন

ময়মনসিংহ শহরের প্রাণকেন্দ্রে গুরুত্বপূর্ণ দুটি সরকারি জমি বেহাত হতে চলেছে। আদালতের আদেশ দেখিয়ে ইতোমধ্যে নগরীর পাটগুদামের শত কোটি টাকার সরকারি জমি বিক্রি হয়ে গেছে মাত্র সাড়ে পাঁচ লাখ টাকায়। অন্যদিকে, শাঁখারীপট্টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৮০ বছরের পুরোনো জমি আদালতের এক রায়ে ব্যক্তিমালিকানায় চলে যাওয়ার পথে।

সময়মতো আইনগত ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ না নেওয়ায় সম্পত্তিগুলোর মালিকানা নিয়ে এখন জটিলতা তৈরি হয়েছে। পুরো বিষয়টি ঘিরে জেলা প্রশাসক ও সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের গাফিলতি ও রহস্যজনক নীরবতা নিয়ে সচেতন মহলে নানা প্রশ্ন উঠেছে। সরকারের শত কোটি টাকার জমি এভাবে হাতছাড়া হতে থাকলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না সরকার।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নগরীর পাটগুদাম এলাকায় সরকারি খাস খতিয়ানে রেকর্ডভুক্ত ৮৪ শতক জমি বিক্রি হয়ে গেছে মাত্র পাঁচ লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকায়। অথচ বাজারমূল্যে এই জমির দাম শত কোটি টাকা। অনুসন্ধানে জানা যায়, এই জমিটি ছিল রেবতী মোহন দাস নামের এক ব্যক্তির। ১৯৬৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর দলিল নং ১০৭ অনুযায়ী জমিটি হস্তান্তর করা হয় আদমজী জুট মিলস লিমিটেডের নামে। এরপর ১৯৬৪ সালে নামজারি সম্পন্ন এবং সরকারিভাবে খারিজ খতিয়ান প্রস্তুত হয়।

বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি) জানায়, জমির দলিলটি পাকিস্তানের করাচি জেলার রেজিস্ট্রি অফিসে সংরক্ষিত আছে এবং এটি বৈধভাবে সরকারি মালিকানায় অন্তর্ভুক্ত। দীর্ঘদিন বিজেএমসি খাজনা পরিশোধও করেছে। কিন্তু মিল বন্ধ হয়ে গেলে জমিটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল। এমনকি বিআরএস জরিপেও জমিটি সরকারি মালিকানায় রেকর্ডভুক্ত হয়।

banner

এ অবস্থায় ২০২২ সালে রেবতী মোহন দাসের ছেলে পরিচয়ে রবীন্দ্র মোহন দাস জমির মালিকানা দাবি করে জেলা প্রশাসক ও বিজেএমসির বিরুদ্ধে মামলা করেন। পরে মামলাটি ২০২৪ সালের ৮ মে আদালত খারিজ করে দেয়। কিন্তু মামলার রায় ঘোষণার আগেই রবীন্দ্র মোহন দাস কৌশলে মিরাশ উদ্দিন সুমন নামের ব্যক্তিকে আমমোক্তারনামা দিয়ে দেন। ওই ব্যক্তি মামলাটি পুনর্জীবিত করে নতুন মামলা দায়ের করেন এবং এই মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া সত্ত্বেও চলতি বছরের ৬ জুন ৮৪ শতক জমি মাত্র পাঁচ লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকায় দাম নির্ধারণ করে বিক্রির দলিল করা হয় । দলিলে দাতা হিসেবে রবীন্দ্র মোহন দাসের নাম ব্যবহার করা হয় এবং তার পক্ষে স্বাক্ষর করেন সিনিয়র সহকারী জজ পবন চন্দ্র বর্মণ।

ময়মনসিংহ সদরের সাব-রেজিস্ট্রার জাহিদ হাসান বলেন, আদালতের নির্দেশ থাকায় তিনি বাধ্য হয়ে দলিল সম্পাদন করেছেন। আদালতের নির্দেশ থাকলে মৌজামূল্য অনুসরণের বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু স্থানীয় ভূমি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সংঘবদ্ধ একটি চক্র পুরোনো কাগজপত্র ব্যবহার করে সরকারি ও বেসরকারি সম্পত্তি অবৈধভাবে হাতিয়ে নিচ্ছে।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, জমিটি সরকারি খতিয়ানভুক্ত। বিজেএমসির মুখ্য পরিচালন কর্মকর্তা নাসিমুল ইসলামও জানিয়েছেন, জমিটি সরকারের মালিকানাধীন। দুদক বলছে, তারা বিভিন্ন দপ্তরের গাফিলতির প্রমাণ পেয়েছে এবং দলিল বাতিলের জন্য আদালতে চিঠি দিয়েছে।

এদিকে, আলোচিত জমিটির দলিলের কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত করার আদেশ দিয়েছেন ময়মনসিংহের সিনিয়র সহকারী জজ আদালত। কিন্তু এত কিছুর পরও প্রশ্ন থেকেই যায় সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত জমি কীভাবে ব্যক্তিমালিকানায় বিক্রি হলো এবং কেন জেলা প্রশাসন তা প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হলো। হাতছাড়া হচ্ছে ৮০ বছরের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি।

ময়মনসিংহের শাঁখারীপট্টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ১৯৪৫ সালে সাত শতক জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৩ সালে বিদ্যালয়টির জাতীয়করণও হয়। সম্প্রতি সরকারি অর্থায়নে বিদ্যালয়ের জরাজীর্ণ ভবন ভেঙে নতুন তিনতলা ভবন নির্মিত হয়েছে। বর্তমানে এখানে তিন শতাধিক শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছে। কিন্তু হঠাৎ করেই বিদ্যালয়টি অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। বিপুল কুমার সিংহ রায় নামে এক ব্যক্তি দাবি করেন, জমিটি তাদের ওয়ারিশান সম্পত্তি এবং অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ ট্রাইব্যুনালের রায়ে তাদের পক্ষে রায় এসেছে। ২০১৩ সালে দায়ের করা মামলার রায় তাদের অনুকূলে আসে এবং পরবর্তী সময়ে আপিল ট্রাইব্যুনালও তাদের পক্ষে রায় দেয়। এরপর তিনি জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন জমিটি বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, প্রায় ১২ বছর মামলা চললেও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিংবা শিক্ষা বিভাগ আদালত থেকে কোনো নোটিস বা সমন পায়নি। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লিপি মনি বলেন, আমরা এ বিষয়ে কিছুই জানতাম না। কোনো নোটিসও পাইনি। উপজেলা শিক্ষা অফিসার মনিকা পারভীনও একই কথা বলেন। শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রতিষ্ঠার ৮০ বছর পর কীভাবে বিদ্যালয়ের জমি ব্যক্তিমালিকানায় চলে যায়? নিশ্চয়ই এখানে প্রভাবশালী চক্র ও প্রশাসনের ব্যর্থতা আছে।

স্কুলের জমির মালিকানা দাবিদার বিপুল কুমার সিংহ রায় বলেন, ট্রাইব্যুনাল আপিলে আমরা জিতে ডিসির কাছে খারিজ চেয়েছি। আদালত আমাকে মালিকানার স্বীকারোক্তি দিয়েছে। তিনি আরো বলেন, ২০১৩ সালে তিনি এ মামলা করেন। মামলায় ওয়ারিশান হিসেবে দুটি রায় তাদের পক্ষে এসেছে।

দুটি সরকারি জমি রক্ষায় জেলা প্রশাসন সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বলে স্থানীয় সচেতন মহল মনে করে। তারা বলেন, পাটগুদামের জমির মামলায় প্রশাসনের তৎপরতা থাকলে শত কোটি টাকার জমি পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি হওয়ার মতো অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটত না। আবার শাঁখারীপট্টি বিদ্যালয়ের মামলায় ১২ বছর ধরে শিক্ষা বিভাগ ও বিদ্যালয় কোনো নোটিস না পাওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে প্রশাসন ইচ্ছাকৃতভাবে নীরব থেকেছে, অথবা গাফিলতি করেছে।

এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক মুফিদুল আলম ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রাজস্ব আজিম উদ্দিনের সরকারি করপোরেট নম্বরে বারবার যোগাযোগ করলেও তারা কল রিসিভ করেননি।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. ওবায়দুল্লাহ আমার দেশকে বলেন, শাঁখারীপট্টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি ব্যক্তি মালিকানায় নিতে জেলা প্রশাসককে বিবাদী করে জমির মালিকানা দাবি করেছে বিপুল কুমার সিংহ রায় নামের এক ব্যক্তি। আমাদেরকে বিবাদী করেনি। আমাদের বিবাদী করলে আমরা আদালতে নিয়মিত জবাব দিতে পারতাম। ষড়যন্ত্র করে এই কাজটি করা হয়েছে। নিশ্চয়ই এখানে জেলা প্রশাসকের ব্যর্থতা রয়েছে। আমরা এ ঘটনায় আমাদের আইন শাখায় কথা বলেছি। কয়েকদিনের মধ্যেই হাইকোর্টে রিট করা হবে।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতোমধ্যে প্রশাসনিক অবহেলার প্রমাণ পেলেও সরকারের পক্ষ থেকে এখনো জেলা প্রশাসক বা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় জনমনে প্রশ্ন জাগছে।

জেলার সচেতন মহলের দাবি, ঘটে যাওয়া এই দুটি ঘটনা সরকারের কয়েকশ কোটি টাকার সম্পদকে হুমকির মুখে ফেলেছে। প্রশাসনের উদাসীনতা, অবহেলা ও রহস্যজনক নীরবতায় আদালতের আদেশকে হাতিয়ার করে সরকারি জমি হাতিয়ে নিচ্ছে সংঘবদ্ধচক্র। জরুরি ভিত্তিতে জেলা প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে স্বচ্ছ তদন্ত করা এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় ময়মনসিংহ নয়, সারা দেশেই সরকারি সম্পদ এভাবে একে একে ব্যক্তির দখলে চলে যাবে।

“সুত্র: দৈনিক আমার দেশ”

এই সম্পর্কিত আরো পোস্ট দেখতে পারেন

কমেন্ট লিখুন