কোথাও সড়কের ঢালাই ভেঙে লোহার রড বেরিয়ে আছে, কোথাও ভেঙে তৈরি হয়েছে বড় বড় গর্ত। সেই গর্তে পানি জমে চলাচলে ঝুঁকি তৈরি করছে। রাজধানীর প্রধান ও অলিগলির অনেক সড়কেই এখন এমন ভাঙাচোরা অবস্থায় রয়েছে। এতে দুর্ভোগে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। শুধু সড়ক নয়, রাজধানীর ওভারব্রিজগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে স্কেলেটরগুলো নষ্ট অবস্থায় পড়ে আছে। সেগুলো মেরামত না করায় হকাররা সেখানের দামি যন্ত্রাংশও খুলে নিয়ে যাচ্ছে। রাজধানীর এয়ারপোর্ট ওভারব্রিজে এমন চিত্র দেখা গেছে। এমন বেহাল অবস্থায় সড়ক ও নাগরিক সেবা চললেও উদাসীন দেখা যাচ্ছে নগর কর্তৃপক্ষকে। সড়ক সংস্কারে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরে দুই সিটি করপোরেশনের কর্তৃপক্ষকে বেশির ভাগ সময় আন্দোলন ঠেকানো ও রাজনৈতিক প্রোগ্রামে সময় কাটাতে দেখা গেছে।
উত্তর সিটি করপোরেশনের উত্তরা, ভাটারা, ‘গুলশান লেক ড্রাইভ’ সড়ক, মিরপুরের রূপনগর, শাহ আলীবাগ, সেনপাড়া পর্বতা, শেওড়াপাড়া, কাফরুল, পূর্ব বাইশটেকি, বাড্ডার গোপীপাড়া, সাতারকুল, মহাখালী দক্ষিণপাড়া, মধুবাগ, মালিবাগ চৌধুরীপাড়া, রামপুরা, হাতিরঝিল এসব এলাকায় অলিগলির বহু রাস্তা ভেঙে গেছে। ঢাকা উত্তর সিটিতে সড়কের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ১ হাজার ৩৪০ কিলোমিটার। এর মধ্যে প্রধান সড়ক ১৯০ কিলোমিটার, সংযোগ সড়ক ৩৪৫ কিলোমিটার, আর অলিগলি ৮০৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে নতুন যুক্ত ১৮টি ওয়ার্ডসহ প্রায় ৩৪০ কিলোমিটার সড়ক এখনই সংস্কারের প্রয়োজন, যা মোট সড়কের প্রায় ২৫ শতাংশ। ডিএনসিসির প্রকৌশল বিভাগ জানায়, গত অর্থবছরে (২০২৪-২৫) ৬১ কিলোমিটার সড়ক, ৫২ কিলোমিটার নালা ও ১৬ কিলোমিটার ফুটপাত উন্নয়ন করা হয়েছে, যার জন্য ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩৭৮ কোটি টাকা। বিশেষ উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় আরও প্রায় ৩৯ কিলোমিটার রাস্তা ও ৪৮ কিলোমিটার নালার কাজ হয়েছে, এতে ব্যয় হয়েছে ৩৩৮ কোটি টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উত্তরায় বিভিন্ন সেক্টরের সড়ক ভেঙে গেছে। অনেক সড়ক যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে গেছে। উত্তরা ১০ নং সেক্টরের সংলগ্ন জনবহুল এলাকা কামাড়পাড়া দীর্ঘদিন ধরে খোঁড়াখুঁড়ি চলায় সেখানে চলাচলের অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে সড়ক। এছাড়া ১৬ নম্বর সেক্টরের সড়কগুলোর অবস্থা বেশি নাজুক। রামপুরা ও হাতিরঝিল এলাকার সড়কগুলোর অবস্থাও বেশ খারাপ। রাস্তা ভাঙাচোরা এবং যানজট এখানকার নিত্যদিনের চিত্র। বৃষ্টির দিনে এই রাস্তাগুলোতে চলাচল করা বেশ কষ্টকর হয়ে যায়। রাস্তা খারাপ থাকার কারণে প্রায়ই এখানে তীব্র যানজট দেখা যায়। বিশেষ করে অফিস ও স্কুল-কলেজের সময় এই যানজট আরও বাড়ে।
উত্তর সিটি করপোরেশনের মিরপুর ১০, শেওড়াপাড়ার অলিগলির সড়কগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। কার্পেট উঠে গিয়ে বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। কিছু সড়কে ওয়াসার পানির লাইন বসানোর কারণে সড়কে আধা কিলোমিটার পর পর কাটা হয়েছে। পানির লাইনের কাজ শেষ হলেও সড়কগুলো কাটা মেরামত করা হয়নি। শেওড়াপাড়া মেট্রো স্টেশন থেকে ৬০ ফিট যাওয়ার সড়কের অবস্থায় বেশি খারাপ। কিছু সড়ক এমন অবস্থায় রয়েছে যে, বৃষ্টি হলে সাধারণ একজন মানুষ হেঁটেও সড়ক পার হতে কষ্ট হয়। এই এলাকার বাসিন্দা শামীম আলী বলেন, দীর্ঘদিন সড়কগুলো খারাপ অবস্থায় থাকলেও কারো কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। গত এক বছরে তো কেউ এই এলাকায় দেখতেও আসেনি।
মিরপুরের সেনপাড়া-পর্বতা এলাকায় একটি গার্মেন্টসের সামনের রাস্তা পুরোপুরি ভেঙে গেছে। রিকশায় ওঠা যাত্রীদের বসে থাকাই দায়। সেখানকার বাসিন্দা শরীফ ইসলাম বলেন, শুকনা মৌসুমে ধুলা, বর্ষায় কাদা সব সময় দুর্ভোগ। এ রাস্তায় এখন হেঁটে চলতেও ভোগান্তিতে পড়তে হয়। ভাটারা মাদানি অ্যাভিনিউতেও একই অবস্থা। ছোট-বড় অসংখ্য গর্তে পানি জমে একেক জায়গা যেন ডোবায় পরিণত হয়েছে। যানবাহনগুলো গর্ত এড়িয়ে চলছে, ফলে সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট।
রাজধানীর গুলশান ও বাড্ডার মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া লেকপাড়ের ‘গুলশান লেক ড্রাইভ’ সড়কটি এখন চলাচলের অনুপযোগী। সড়কের বিভিন্ন অংশে পিচ উঠে গিয়ে ছোট-বড় গর্ত আর খানাখন্দে ভরে গেছে। গর্তে জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে গভীরতা বোঝার উপায় নেই। এতে যানবাহন চলছে ধীরগতিতে, ঝুঁকি নিয়ে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় ১ হাজার ৬৫৬ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। এর মধ্যে সব মিলিয়ে প্রায় ১০০ কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আছে বলে জানা যায়। মৌচাক, মানিকনগর, টিটিপাড়া, গোপীবাগ, মালিবাগ, রাজারবাগ, সায়েদাবাদ, ওয়ারী, গেণ্ডারিয়া, টিকাটুলী, নারিন্দা, দয়াগঞ্জ, কমলাপুর, খিলগাঁও এবং পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকার সড়কে খানাখন্দ ও গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। আবার অনেক সড়কের ম্যানহোলের ঢাকনা নেই। যেখানে লাল কাপড় বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
দয়াগঞ্জ মোড় থেকে জুরাইন রেলগেট পর্যন্ত গেন্ডারিয়া নতুন সড়কটি প্রথম দেখায় মনে হতে পারে যেন খালে অথৈ পানি। সড়কের জায়গায় জায়গায় গর্তের আকার এত বড় যে, সামান্য বৃষ্টি হলেই তলিয়ে যায় কয়েক ফুট পানির নিচে। ভাঙা সড়কের মাঝেই জলাবদ্ধতা থাকে কয়েক দিন। রাজধানীর খিলগাঁও উড়ালসড়কের মুখ থেকে শুরু করে নন্দীপাড়া ব্রিজ পর্যন্ত সড়কটি (এটি বাসাবো-মাদারটেক সড়ক নামে পরিচিত) খানাখন্দে ভরা। কোথাও বড় বড় গর্ত। আবার কোথাও ছোট ছোট। তবে যেসব স্থানে বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে, সেগুলোর অনেক স্থানে ইট বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরপর বৃষ্টিতে পানি জমে থাকার কারণে অনেক স্থানে ইট উঠে গেছে। রাস্তা ভাঙাচোরা হওয়ার কারণে দিনভর এই পথে যানজট লেগেই থাকে। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, ভারী যানবাহন চলাচল এবং নিম্নমানের কাজের কারণেও সড়ক ভেঙেছে। বছরের শুরুতেই সিটি করপোরেশনের সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির একটি পথনকশা বা রোড ম্যাপ থাকলে এমন হতো না। ‘গুলশান লেক ড্রাইভ’ সড়কটির বিষয়ে অঞ্চল-৩-এর নির্বাহী প্রকৌশলী নুরুল আলম জানান, সড়ক সংস্কারে প্রায় ১৯ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। বর্ষা শেষে কাজ শুরু হবে এবং মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য রয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ফারুক হাসান মো. আল মাসুদ বলেন, চলতি অর্থবছর উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ রয়েছে প্রায় ৬৯০ কোটি টাকা। বিশেষ উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য রাখা হয়েছে ৯৯০ কোটি টাকা। এর আওতায় রাস্তা, ফুটপাত ও নর্দমার কাজ করা হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী কাজী মো. বোরহান উদ্দিন বলেন, কোথাও ছোট সংস্কার থাকলে সেটা তাৎক্ষনিক করা হচ্ছে। অন্য ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলো বর্ষা শেষে সেপ্টেম্বরের দিকে শুরু হবে।
সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক