দেড় কোটি টন পাথর লুট। ১১ লাইনে পাঁচটি বাক্যে এজাহার। আসামি দুই হাজার। সাক্ষী গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন। বাদী খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো (বিএমডি)।
এটিই সিলেটের ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর লুটের ঘটনায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে বড় তৎপরতা। গত শুক্রবার কোম্পানীগঞ্জ থানায় বিএমডি মামলাটি করেছে। আসামি হিসেবে কারও নাম উল্লেখ নেই; সব অজ্ঞাত।
সিলেটের গেজেটভুক্ত পাথর কোয়ারির দুই হাজার ৬২ একর জমি বিএমডির অধীন। কিন্তু সিলেটে তাদের কোনো কার্যালয় নেই। তাদের পক্ষে স্থানীয় জেলা প্রশাসন ওই সম্পদ তদারক করে।
বিএমডির মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকা যুগ্ম সচিব মো. আনোয়ারুল হাবীবের স্বাক্ষর করা পাঁচ বাক্যের এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ‘অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতকারীরা গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ১২ আগস্ট পর্যন্ত কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ গেজেটভুক্ত পাথর কোয়ারি থেকে অবৈধ ও অননুমোদিতভাবে কোটি কোটি টাকার পাথর লুট ও চুরি হয়েছে মর্মে বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী লুটপাটে অজ্ঞাতপরিচয় দেড় থেকে দুই হাজার ব্যক্তি জড়িত বলে ধারণা করা হচ্ছে, যাদের পরিচয় শনাক্ত করা হয়নি। সরকারের গেজেটভুক্ত কোয়ারি থেকে পাথর লুট ও চুরি– এ ধরনের কর্মকাণ্ডে খনি ও খনিজ সম্পদ (নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন) আইন, ১৯৯২-এর ধারা ৪(২)(ঞ) এবং খনি ও খনিজ সম্পদ বিধিমালা, ২০১২-এর বিধি ৯৩(১) লঙ্ঘিত হয়েছে। এতে দণ্ডবিধি ১৮৬০ সালের ৩৭৯ ও ৪৩১ ধারায় অভিযোগ দায়ের করা প্রয়োজন।’ মামলা তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হয়।
সিলেট জেলা বারের আইনজীবী শহিদুজ্জামান চৌধুরী বলেন, আইনের দৃষ্টিতে বিএমডির করা এজাহারটি খুব দুর্বল। কোনো বাদী আইনের ধারা রুজুর নির্দেশ করতে পারেন না। কোন ধারায় মামলা হবে, তা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ঠিক করবেন। এজাহারে দেখা গেছে, দণ্ডবিধি ও বিশেষ আইনের ধারা একসঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে। এটি হয় না।
বিএমডির মামলার এজাহার বিষয়ে মন্তব্য না করে এই কর্মকর্তা বলেন, যেভাবে এজাহার এসেছে, সেভাবে নথিভুক্ত করা হয়েছে।
সিলেটের পুলিশ সুপার মাহবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, এজাহারে কিছু দুর্বলতা আছে। আসামির নামসহ অন্য বিষয়গুলো উল্লেখ থাকলে পুলিশের জন্য তদন্ত সহজ হতো। এই এজাহারের ভিত্তিতে অভিযোগ প্রমাণ করা কঠিন হবে।
জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, সিলেট জেলায় খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ছয়টি বালুমিশ্রিত পাথর কোয়ারি রয়েছে। এসব কোয়ারির জায়গার পরিমাণ দুই হাজার ৬২ একর। কোয়ারিগুলো বিএমডি থেকে ইজারা দেওয়া হয়। ২০১৫ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে সব পাথর কোয়ারির ইজারা বন্ধ রয়েছে।
তিন বছর ধরে বিএমডির একাধিক প্রতিনিধি দল পাথরের দাম নির্ধারণ ও ইজারার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে একাধিকবার সিলেট পরিদর্শন করে। এসব কোয়ারি মূলত ইজারা দেয় খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো। জেলা প্রশাসন শুধু দখল বুঝিয়ে দেয়।
গত ২২ জানুয়ারি রুটিন দায়িত্বে থাকা বিএমডির পরিচালক মামুনুর রশীদ সিলেটের পাঁচটি পাথর কোয়ারি ইজারা প্রদানে বাধা নেই বলে প্রস্তাব দাখিল করেন। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) মামলার কারণে পাথর কোয়ারির ইজারা স্থগিত ছিল চার বছর।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দেশের সব কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত স্থগিত করে। গত ১৩ জানুয়ারি ওই স্থগিতাদেশ বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রণালয়। এতে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় উদ্বেগ প্রকাশ করে।
পরে ২৭ এপ্রিল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে এক সভায় পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সিলেটের পর্যটন আকর্ষণ বিবেচনায় পাথর তোলার ক্ষতিকর দিক উপস্থাপন করেন। ওই সভায় দেশের ৫১ কোয়ারির মধ্যে ১৭টির ইজারা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত হয়। পাথর লুট অব্যাহত থাকায় ১৪ জুন জাফলং ইসিএভুক্ত এলাকা পরিদর্শনে যান সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। ওই দিন দুই উপদেষ্টার গাড়িবহর আটকে দেন বালু-পাথর ব্যবসায়ী, বিএনপির নেতাকর্মী ও শ্রমিকরা। পরে এ ঘটনায় মামলাও হয়।
গত এক বছরে থানায় পরিবেশ অধিদপ্তরের তিনটিসহ ছয়টি মামলা হয়েছে উল্লেখ করে গোয়াইনঘাট থানার ওসি সরদার তোফায়েল আহমদ জানান, আজকালের মধ্যে উপজেলা প্রশাসন পাথর লুটের অভিযোগে একটি মামলা করবে।
কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উজায়ের আল মাহমুদ আদনান জানান, তাঁর জানামতে খনিজ বিভাগের কেউ ভোলাগঞ্জ আসেননি। পাথর-সংক্রান্ত ইস্যুতে থানায় ১৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে পাথরবাহী ট্রাক আটকাতে গিয়ে চারবার পুলিশ হামলার শিকার হয়।
জেলা প্রশাসনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার (আরডিসি) মাহমুদ আশিক কবির জানান, বিএমডির স্থানীয় কোনো কার্যালয় আছে বলে তাঁর জানা নেই। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের নির্দেশনা, কাজের তদারকি তারাই করেন।
বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেটের পরিচালক ফেরদৌস আনোয়ার বলেন, ‘খনিজের জায়গায় আমাদের সরাসরি হস্তক্ষেপের সুযোগ কম। খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো বা জেলা প্রশাসন আমাদের যুক্ত করলে আমরা অংশ নিই। পাথর কোয়ারি এলাকায় পরিবেশ নষ্টের অভিযোগে একাধিক মামলা আমরা করেছি।’
গত রোববার মামলার বিষয়ে কথা বলতে চাইলে বিএমডির মহাপরিচালক আনোয়ারুল হাবীব জানান, তিনি সিলেটের পাথর নিয়ে ব্যস্ত আছেন। পরে ফোন করার পরামর্শ দিলেও গত দুদিনে আর ফোন ধরেননি।
তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় বাড়ল
সাদাপাথর লুটের ঘটনায় জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন দেওয়ার সময় তিন দিন বাড়ানো হয়েছে। আজ বুধবার তাদের তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। কমিটির প্রধান সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (উন্নয়ন ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা) পদ্মাসন সিংহ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
“সুত্র: দৈনিক সমকাল”