Home » নারী ও শিশু পাচার: ২০২৫ সালে বাংলাদেশে এক ভয়াবহ সামাজিক সংকট

নারী ও শিশু পাচার: ২০২৫ সালে বাংলাদেশে এক ভয়াবহ সামাজিক সংকট

0 মন্তব্য গুলি 3 জন দেখেছে 4 মিনিট পড়েছেন

মরিয়ম রহমান উর্মি (অ্যাডভোকেট)
জজ কোর্ট, সিরাজগঞ্জ।

২০২৫ সালে বাংলাদেশে নারী ও শিশু পাচার একটি বড় সামাজিক সংকট হিসেবে বিদ্যমান। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও জাতীয় সংস্থা জরিপ ও গবেষণার মাধ্যমে দেখিয়েছে, পাচারের শিকার নারী ও শিশুর সংখ্যা এখনও উদ্বেগজনকভাবে বেশি। UNICEF এর ২০২৫ সালের রিপোর্ট “Stopping the Traffic” অনুযায়ী, বাংলাদেশে হাজার হাজার নারী ও শিশু এখনও পাচারের ঝুঁকিতে রয়েছে।
বাংলাদেশের গরীব ও সামাজিকভাবে অনিশ্চিত জীবনপ্রেক্ষাপট অনেকসময় পরিবারের সদস্যদের জীবন বদলানোর আশায় সহজ সরল সিদ্ধান্ত নিতে উত্সাহিত করে। দরিদ্র পরিবারের একজন মা বা কিশোরী মেয়েকে ভালো কাজের প্রলোভন দেখিয়ে কোনো এজেন্ট বা পরিচিতি বিদেশে পাঠানোর কথা বলে; কোন কাজে যাবে, কত প্ল্যাটফর্মে কাজ করবে, বেতন কী—এসব কথা মসৃণ কথাবার্তায় বর্ণনা করা হয়। অনেকসময় “নিরাপদ গৃহকর্ম” বা “অফিসে ভালো বেতন”–এর প্রতিশ্রুতি দিয়ে মেয়েদের বিদেশে নেওয়া হয়; কিন্তু পৌঁছানোর পর দেখতে পাওয়া যায় চুক্তির শর্ত ভিন্ন, কাজের সময়সীমা অতিরিক্ত, পারিশ্রমিক দিতে অস্বীকার বা শ্লীলতাহানির শিকার করা হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে পাচারকারীরা ভিসা, কাগজপত্র বা টিকিট বানিয়ে দিলেও তারা প্রয়োজনীয় তথ্য আড়াল করে, অথবা পাসপোর্ট ও যোগাযোগের মাধ্যম দখল করে রেখে দেয়, যাতে ভিকটিম পিছনে ফিরে আসতে না পারে বা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ সীমিত হয়।

এছাড়া শিশুদের পাচার হওয়ার পেছনে থাকে আরও নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য — শিশুশ্রম, যৌনশ্রম, জোরপূর্বক বিবাহ বা অবৈধ দত্তক দেয়ার চক্র। অভিভাবকরা দুর্বল আর্থিক অবস্থার কারণে কখনো কখনো চুক্তিভিত্তিক দত্তকের আশায় সন্তানকে ‘বিক্রি’ করে দেওয়ার মতো ভুল সিদ্ধান্তও নেন। অপরদিকে organised criminal network শিশুকে চিহ্নিত করে নেয় ও বিভিন্ন ধরনের কাজে বাধ্য করে — কখনো তা চোরাচালান বা মাদক পরিবহনের জন্য ব্যবহার, কখনোই যৌনশিল্পে বাধ্যতা।
এখনকার বিশ্বায়ন ও অনলাইন যোগাযোগ সহজ হওয়ায় প্রতারণার কৌশলও জটিল হচ্ছে; সামাজিক মাধ্যম বা অনলাইন চাকরির বিজ্ঞাপনে অতিরঞ্জিত বেতনের প্রতিশ্রুতি, জাল প্রতিষ্ঠান ও ভুয়া চুক্তিপত্র দিয়ে মানুষকে ফাঁদে ফেলা হয়। যারা বিদেশে যেতে চান, তাদের মধ্যে যে দায়িত্বপ্রবণতা থাকা উচিত—কিন্তু প্রায়শই তাড়াহুড়ো, পরিবারের চাহিদা বা ঋণ তাদের সতর্কতা হ্রাস করে। এজেন্টরা দেনা-বদ্ধতার (debt bondage) কৌশলেও লিপ্ত থাকে: যাওয়া-আসার খরচ, ভিসা ফি বা এজেন্টের দামে ঋণ করে দেবেন—এর ফলে ভিকটিমকে পরবর্তীতে কম দামে কাজে বা দাসত্বে বাধ্য করা সহজ হয়।

এই পাচারের ফলাফল একদিকে শারীরিক নির্যাতন, যৌন হেনস্থার শিকার হওয়া, মানসিক অসুস্থতা ও দীর্ঘস্থায়ী ট্রমা; অন্যদিকে পরিবারের উপর আর্থিক চাপ এবং সামাজিক কলঙ্ক হিসেবে ফিরে আসে। ভুক্তভোগী ছাড়া যেসব শিশু বা নারী ফিরে আসে, তাদের পুনর্বাসন ও সামাজিক পুনর্গঠনে সময়, অর্থ ও টেকনিক্যাল সাপোর্ট লাগে—এবং অনেক ক্ষেত্রেই পর্যাপ্ত সহায়তা না পেলে তারা সম্পূর্ণরূপে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন না।

banner

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS) ও UNFPA পরিচালিত Violence Against Women Survey 2024 দেখিয়েছে যে, ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সী নারীদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ নারী জীবনের কোনো না কোনো সময়ে স্বামী বা সঙ্গীর দ্বারা শারীরিক, মানসিক, যৌন বা অর্থনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। গত ১২ মাসে এই ধরনের সহিংসতার হার ছিল প্রায় ৪১ শতাংশ। যদিও ২০১৫ সালের তুলনায় কিছুটা কমেছে, তবুও এটি অত্যন্ত উচ্চ হারে রয়ে গেছে।

পাচারের ক্ষেত্রে শিশুদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। বিভিন্ন গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের যৌনপণ্য শিল্পে শিকারদের প্রায় ২২ শতাংশই শিশু। জাতীয় কন্যাশিশু অধিকার অ্যাডভোকেসি ফোরাম (NGCAF) জানিয়েছে, ২০২৫ সালের প্রথম আট মাসেই ৩৯০ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, ৫৪ জন যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে, এবং ৩৪ জন শিশু অপহরণ বা পাচারের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ১৮ জনকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।

অন্যদিকে, সরকারের Trafficking in Persons Report 2024 এ বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে মোট ১,২১০ জন পাচারের শিকার ব্যক্তি শনাক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে ২১০ জন যৌন পাচারের, ৭৯৫ জন জোরপূর্বক শ্রমের এবং ২০৫ জন অন্যান্য ধরনের পাচারের শিকার। তবে বেসরকারি সংস্থাগুলো বলছে, প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি—তাদের অনুমান অনুযায়ী পাচারের শিকার মানুষের সংখ্যা প্রায় ১০,১৩৫, যার মধ্যে ১,৭৮৪ জন যৌন পাচারের শিকার।

এই পরিস্থিতির পেছনে মূল কারণ হিসেবে দারিদ্র্য, বেকারত্ব, সামাজিক বৈষম্য, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বাস্তুচ্যুতি, শিক্ষার অভাব এবং পাচারকারীদের নতুন কৌশলকে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশেষত অনলাইন রিক্রুটমেন্ট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার এবং ডিজিটাল মাধ্যমে প্রতারণার কারণে নতুন করে নারী ও শিশুরা ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে।

যদিও সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যেমন “Project Shurakkha” নামের উদ্যোগের মাধ্যমে শিশুদের সুরক্ষায় কাজ করা হচ্ছে, তবে বাস্তবতা হলো—অভিযোগের বড় অংশ আদালতে পৌঁছায় না, আর অপরাধীদের শাস্তি পাওয়ার হার খুবই কম। এর ফলে পাচারকারীরা আরও সাহসী হয়ে উঠছে এবং ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

সার্বিকভাবে দেখা যায়, ২০২৫ সালের জরিপ ও পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে নারী ও শিশু পাচার কমেনি, বরং এর প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়ে আরও জটিল হচ্ছে। আইনি কাঠামো, সামাজিক সচেতনতা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা থাকলেও মূল সমস্যা হচ্ছে আইন প্রয়োগ, শিকারদের সুরক্ষা ও পুনর্বাসন, এবং পাচারের মূল কারণগুলোর সমাধান করতে না পারা। ফলে ভবিষ্যতে এই সংকট মোকাবিলায় আরও সুসংহত ও সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

এই সম্পর্কিত আরো পোস্ট দেখতে পারেন

কমেন্ট লিখুন