উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে নেপাল। রাজধানী কাঠমান্ডুর গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনাগুলো জ¦লছে দাউদাউ করে। প্রেসিডেন্ট ভবন, পার্লামেন্ট ভবন, এমপি-মন্ত্রীদের বাড়ি, সংবাদমাধ্যমসহ অসংখ্য স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। জেনারেশন-জেড বা জেন-জিদের দুদিনের বিক্ষোভে গোটা নেপাল কার্যত অগ্নিগর্ভে পরিণত হয়েছে। পরিস্থিতি শান্ত করতে গতকালই দেশটির প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি পদত্যাগ করেছেন। পদত্যাগপত্রে তিনি লিখেছেন, সংকট সমাধানের সাংবিধানিক সমাধানের পথ প্রশস্ত করতেই তিনি এই পদক্ষেপ নিয়েছেন। অন্যদিকে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, নেপালের প্রেসিডেন্ট রাম চন্দ্র পৌদেল পদত্যাগ করেছেন। তবে নেপালি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট পরিস্থিতি শান্ত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছেন। খবর বিবিসি, আল জাজিরা ও হিমালয়ান টাইমস।
নেপালের সুবিধাভোগী ধনীক শ্রেণি ও সরকারের দুর্নীতির কারণে অসন্তোষ বিরাজ করছিল। এর মধ্যে সম্প্রতি সরকার সামাজিক মাধ্যমের ওপর নতুন নিয়ম চাপিয়ে দেয়। বিধি লঙ্ঘনের অজুহাত তুলে গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে ২৬টি সামাজিক মাধ্যম বন্ধ করে দেয় কেপি শর্মার সরকার। এ থেকেই ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। গত সোমবার তার বিস্ফোরণ ঘটে। প্রথম দিনেই পুলিশের গুলিতে ১৯ জন আন্দোলনাকারী নিহত হন। আহত হন তিন শতাধিক লোক। গতকাল আরও দুজন মারা গেছেন। কাঠমান্ডু পোস্ট জানিয়েছে, নেপালের ইতিহাসে অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম রয়েছে কিন্তু একদিনে সরকারি বাহিনীর হাতে এত মানুষ নিহতের সংখ্যা এই প্রথম। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ আনতে সরকার সোমবার কারফিউ জারি করে। গতকাল সকাল থেকেই কারফিউ উপেক্ষা করে রাজপথে অবস্থান করে হাজার হাজার ক্ষুব্ধ জনতা।
মঙ্গলবার দিনের শুরু থেকেই আন্দোলনকারীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। পুলিশের
ব্যারিকেড, কারফিউ উপেক্ষা করে তারা পার্লামেন্ট ভবনে জড়ো হতে থাকে। এক সময় তারা প্রেসিডেন্ট কার্যালয় শীতল নিবাসে অগ্নিসংযোগ করে। সকালেই দিকেই ভক্তপুরের বালাকোটে কেপি শর্মার ব্যক্তিগত বাসভবনের দিকে বিক্ষোভকারীরা রওনা দেয়। এ সময় পুলিশ তাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও কোনো কাজ হয়নি। অবশেষে অলির বাসভবনের প্রাঙ্গণে দুটি বাড়িতে আগুন দেয় তারা। কেপি শর্মা অলি পদত্যাগের ঘোষণার পরও পার্লামেন্ট ভবন তছনছ করে আন্দোলনকারীরা। এ সময় অনেকেই ভেতরে প্রবেশ করে ‘বিজয় সূচক’ ছবি সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করেন।
সরকারের ক্ষমতাসীন জোটের শরিক নেপালি কংগ্রেস পার্টির কার্যালয়েও ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। ললিতপুরে তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী পৃথ্বী সুব্বা গুরুংয়ের বাড়িতে আগুন দেয় ক্ষুব্ধ জনতা। পদত্যাগ করা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখকসহ বেশ কয়েকজন এমপি-মন্ত্রীর বাড়ি লক্ষ্য করে হামলা করে ও আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এ পরিস্থিতিতে কাঠমান্ডুর আন্তর্জাতিক ত্রিভুবন বিমানবন্দরে সব ধরনের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে।
আন্দোলনের হোতা ডিজে সুদান গুরুং?
নেপালের একাধিক সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, জেন-জিদের একত্রিত করতে বড় ভূমিকা রেখেছেন ৩৬ বছর বয়সী তরুণ সুদান গুরুং। তিনি ডিজে এবং সমাজসেবক হিসেবে পরিচিত। ‘হামি নেপাল’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন চানালন তিনি। গত সোমবার এই সংগঠনটিই স্কুল পড়–য়াদের সমবেত হওয়ার ডাক দিয়েছে। খবরে বলা হয়েছে, সুদান গুরুং শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের ডাকই দিয়েছিলেন কিন্তু পুলিশ আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি করলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়।
রাজনৈতিক শূন্যতায় ভয়াবহ সহিংসতার আশঙ্কা :
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই বিক্ষোভে নেপালের রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ স্পষ্ট। যার আঁচ পাওয়া গেছে অনেক এমপি-মন্ত্রীর বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায়। বেশ কয়েকজন এমপি-মন্ত্রী নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে আশ্রয় নিয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিক্ষোভকারীরা দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান ছাড়া তেমন কোনো দাবি স্পষ্ট করেনি। অধিকাংশ জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক গা-ঢাকা দিয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধানসহ আমলারা আন্দোলনকারীদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। এতে দেখা গেছে দেশটিতে রাজনৈতিক শূন্যতা দেখা দিতে পারে। শিগগির কোনো সরকার বা কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব না নিলে সহিংসতা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
শান্ত থাকার আহ্বান সেনাবাহিনীর
নেপালের সেনাবাহিনী বিক্ষুব্ধ তরুণ প্রজন্মকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে সেনা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা নেপাল ও নেপালি জনগণের স্বার্থরক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এর আগে নেপালের প্রেসিডেন্ট রাম চন্দ্র পৌদেল জেন-জিদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ যোগাযোগ ও সমাধানের পথ খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়েছেন।
৩ মন্ত্রীর পদত্যাগ
পানি সরবরাহমন্ত্রী প্রদীপ যাদব পদত্যাগ করেছেন। জেন-জিদের আন্দোলনে তিনি সমর্থন জানিয়ে বলেছেন, প্রিয় তরুণ ভাইবোনেরা; তোমরাই আমার প্রথম সঙ্গী ও আমার শক্তির উৎস। আমি সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি এবং যুবশক্তিকে সঠিক পথে আসার আকুল আবেদন জানাচ্ছি। এর আগে আরও দুই মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন- তারা হলেন কৃষিমন্ত্রী রামনাথ অধিকারী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখক।
কাঠমান্ডু পোস্ট কার্যালয়ে হামলা
নেপালের অন্যতম সংবাদমাধ্যম কাঠমান্ডু পোস্টের কার্যালয়ে হামলা করা হয়েছে। সংবাদমাধ্যমটির দপ্তরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে আন্দোলনকারীরা। সামাজিক মাধ্যমে এক পোস্টে বলা হয়েছে, হামলার কারণে সংবাদমাধ্যমটির সার্ভার বন্ধ হয়েছে এ কারণে ওয়েবসাইটের কার্যক্রম মারাত্মক ব্যাহত হয়েছে।
“সুত্র: আমাদের সময়”