তৃণমূলের সংবাদ ডেস্ক:
জুলাই সনদ নিয়ে শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর কোর্টে বল ঠেলে দিয়েছে সরকার। দলগুলোকে এ বিষয়ে নিজেদের মধ্যে সমাধানের জন্য তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিতে তাগিদ দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হবে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত। বহুল আলোচিত এই সনদ বাস্তবায়নে দলগুলোকে আর বেশী সময় দিতে চায় না কমিশন। ইতোমধ্যে সর্বশেষ বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোকে সেই বার্তাই দেয়া হয়েছে। এছাড়া দলগুলোর আবেদনের ভিত্তিতেই জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। সোমবার এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ১৫ সেপ্টেম্বর শেষ হয়েছে আগের মেয়াদ। এদিকে দলগুলো নির্ধারিত সময়ের মধ্যে একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবে বলে আশাবাদী ঐকমত্য কমিশন।
তবে জুলাই সনদ নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্য পৌছতে পারেনি দলগুলো। রাজনৈতিক দলগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতে ৮৪টি সংস্কারের সিদ্ধান্ত দিয়েছে কমিশন। ১১টিতে বিভিন্ন দলের নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। উচ্চকক্ষে পিআর, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকা রহিত করা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন পদ্ধতি, কমিটির মাধ্যমে দুদকের নিয়োগ, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতিকে দেয়াসহ ৯ সিদ্ধান্তে বিএনপি নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। জামায়াত গভর্নর নিয়োগ-সংক্রান্ত সিদ্ধান্তসহ কয়েকটিতে নোট অব ডিসেন্ট দিলেও সবকটির বাস্তবায়ন চায়। ইসলামী আন্দোলন রাষ্ট্রপতির নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। এ অবস্থায় প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ চূড়ান্ত করলেও বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে দলগুলো নিজ নিজ অবস্থানে অনড়। জুলাই সনদের মোট ৮৪টি ধারা বা সিদ্ধান্তের মধ্যে বেশ কিছু সিদ্ধান্তে কোনো কোনো দলের নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) রয়েছে। আবার সনদ বাস্তবায়নে তিন ধরনের প্রক্রিয়া রয়েছে। বেশকিছু সিদ্ধান্ত সরকারের নির্বাহী আদেশে বাস্তবায়ন করা যায়। কিছু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অধ্যাদেশ জারি করতে হবে। আর প্রায় ৩৪টি ধারা বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। এক্ষেত্রে নির্বাহী আদেশ এবং অধ্যাদেশ দিয়ে যেসব ধারা বাস্তবায়ন করা যাবে, সেক্ষেত্রে সবগুলো দল একমত। তবে যেসব ধারা বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধন করতে হবে, সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো বিভক্ত।
বিএনপি চায়, নির্বাচনের পরে সাংবিধানিক সংস্কার আগামী সংসদে দুই বছরের মধ্যে হবে। জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন বলছে, বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে নির্বাচনের আগেই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে। সংসদে সনদ অনুমোদন এবং তা গণভোটে গৃহীত হবে, যাতে কেউ বাতিল করতে না পারে।
জানা যায়, গত রোববার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে তৃতীয় দফার দ্বিতীয় দিনের সংলাপ হলেও কোনো দলই সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সরেনি। কমিশনের বিশেষজ্ঞ প্যানেল সাংবিধানিক আদেশ কিংবা গণভোটে সনদ বাস্তবায়নে মত দিয়েছে। তবে সরকার এখনই সেদিকে না গিয়ে রাজনৈতিক সমঝোতায় গুরুত্ব দিচ্ছে। কমিশনের মেয়াদ শেষ হলেও আলোচনা চালিয়ে যেতে মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আমি বারবার আহ্বান করেছি। তাঁরা যথেষ্ট পরিমাণে সাড়া দিয়েছেন, কিন্তু কোনো না কোনো সময় তো প্রক্রিয়াটা শেষ করতে হবে, এটা তো অনিঃশেষ প্রক্রিয়া হতে পারে না। সেক্ষেত্রে নির্বাচনটা করতে হবে। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হলে বাংলাদেশে কেবল অভ্যন্তরীণ অস্থীতিশীলতা তৈরি হবে, তা নয়; জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। আমি তা-ই মনে করি। সেই কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রয়োজন এই জিনিসটা মোকাবিলা করা।’
আলী রীয়াজ বলেন, আগামী নির্বাচনটি আমরা করছি এ কারণে যে রাষ্ট্রকাঠামোর ক্ষেত্রে কতগুলো পরিবর্তন আমরা নিশ্চিত করতে চাই। সংস্কার কমিশনে কাজ করার সময় আমরা দেখেছি, গত ১৬ বছরের যে সংকট, সেটা ১৬ বছরের সংকট নয়। ১৬ বছরের সংকটের ভয়াবহতাটা আমরা দেখতে পেয়েছি, কারণ একটা ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু কাঠামোগত দিক থেকে আমরা বিভিন্নভাবে এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি।
এই ইস্যূতে জামায়াতসহ যুগপৎ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেয়া দলগুলোর নেতারা জানিয়েছে, বিএনপি অভ্যুত্থানের পর অন্যদের মতামতকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। ক্ষমতায় যাবেই ধরে নিয়ে সংস্কারে বাধা তৈরি করেছে। এতে সন্দেহ তৈরি হয়েছে, বিএনপি ক্ষমতায় যেতে পারলে সংবিধান সংস্কার করবে কিনা। নেতারা বলেন, উচ্চকক্ষের পিআর মানতেই হবে। উচ্চকক্ষে পিআরে রাজি করাতেই পুরো নির্বাচন এ পদ্ধতিতে করার জন্য চাপ তৈরি করা হয়েছে, যাতে আলোচনায় বিএনপিকে কিছু ছাড় দেওয়া যায়। বিএনপি উচ্চকক্ষে পিআর মেনে নিলে নিম্নকক্ষে পিআরের দাবি বাদ দেওয়া হবে। তবে বর্তমানে বিএনপি কিছুটা নমনীয় ভাব দেখাচ্ছে। ফ্রেব্রুয়ারীতে নির্বাচনের জন্য তারা ছাড় দিতেও প্রস্তুত বলে জানা গেছে।
গত ২০ মার্চ থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩৫টি দলের সঙ্গে প্রায় ৭০টি বৈঠকের মাধ্যমে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ চূড়ান্ত করেছে ঐকমত্য কমিশন। তবে আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া মূল সনদের সঙ্গে যুক্ত করা হয়নি। সনদে যারা স্বাক্ষর করবেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সেই প্রতিনিধিদের নাম চেয়েছে কমিশন। গত ১৩ সেপ্টেম্বর শনিবারের মধ্যে প্রত্যেক দলকে দুজন প্রতিনিধির নাম পাঠাতে বলা হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ অনেকগুলো দল প্রতিনিধির নাম পাঠায়নি। বক্তব্য আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত না হলে তারা সনদে স্বাক্ষর করবেন না। তবে বাংলাদেশ জাতীয়তবাদী দল (বিএনপি)সহ সমমনা দলগুলো প্রতিনিধির নাম পাঠিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, প্রকাশ্যে কথা না বললেও নির্বাচনের আগে সনদ বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর সরকার। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে কঠোর অবস্থানে যাবে। ৩০ নভেম্বরের মধ্যে সংস্কারসংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করা হবে। সর্বশেষ গত রোববার রাজনৈতিক দলগুলোর কমিশনের বৈঠক হয়। বৈঠকে কমিশনের প্রধান এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস উপস্থিত ছিলেন। এ সময় তিনি বলেন, ঐকমত্যের ভিত্তিতে সনদ বাস্তবায়ন করে সারা বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। সরকারের বার্তা বুঝতে পেরে রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার জন্য কমিশনের মেয়াদ বাড়াতে প্রধান উপদেষ্টার কাছে অনুরোধ করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর অনুরোধে মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সূত্র জানায়, সনদ বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় অংশজন হলো বিএনপি। এতদিন তারা কঠোর অবস্থানে থাকলেও বর্তমানে কিছুটা নমনীয়। অর্থাৎ ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করতে তারা কিছুটা ছাড় দিতে প্রস্তুত রয়েছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, ‘অনেকগুলো বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে। এখন এগুলো বাস্তবায়নের বিষয়। এখন বলটা বহুলাংশে আমাদের রাজনৈতিক দলের কোর্টে। দলগুলোকে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে যে কীভাবে সংস্কার বাস্তবায়িত হবে। একই সঙ্গে এ ক্ষেত্রে সরকারকেও সুস্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে।’
তিনি বলেন, আমরা দাঁড়িয়ে আছি অনেক রক্তের ওপর। এত আত্মত্যাগ যেন ব্যর্থ না হয়। শেখ হাসিনার মতো স্বৈরাচারের পুনরাবির্ভাব যাতে আবার না ঘটে, সেটা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। একই সঙ্গে সরকারকেও তার ভূমিকা যথার্থভাবে পালন করতে হবে।’