Home » চলনবিলে রবীন্দ্রনাথের মুখোমুখি রবীন্দ্রনাথ

চলনবিলে রবীন্দ্রনাথের মুখোমুখি রবীন্দ্রনাথ

0 মন্তব্য গুলি 6 জন দেখেছে 9 মিনিট পড়েছেন

বৃহস্পতিবার। সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস। বৃষ্টিভেজা সকালেই ব্যস্ত ঢাকার রাস্তা। শহুরে ব্যস্ততা পেছনে ফেলে গাড়ি ছুটে চলছে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের পথে। মহাসড়ক ছেড়ে শাহজাদপুরের দিকে সরু পাকা রাস্তা। শহরে ঢুকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি জাগানো কিছু স্থাপনার দেখা মেলে। উপজেলা সদরে দাঁড়িয়ে আছেন খোদ কবিগুরু; ভাস্কর্য হয়ে। শহুরে কোলাহল এখানেও কম নয়।

সেই শহর থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার দূরে চলনবিলের বুড়ি পোতাজিয়া। এই জায়গাটিও রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত। এখন এই জায়গায় তাঁর নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস তৈরি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। আশার কথা, এই বিতর্কে রবীন্দ্র-বিদ্বেষ নেই। আছে প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার তাগিদ।

রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রের কথা মনে পড়ল। তাতে ‘অতিথি’ গল্পের প্রেক্ষাপট বলতে গিয়ে শাহজাদপুরে একটি বর্ণনা আছে– ‘একটু একটু করে লিখছি এবং বাইরের প্রকৃতির সমস্ত ছায়া-আলোক-বর্ণ-ধ্বনি আমার লেখার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। আমি যে সকল দৃশ্যলোক ও ঘটনা কল্পনা করছি তারই চারিদিকে এই রৌদ্রবৃষ্টি, নদীস্রোত এবং নদীতীরের শরবন, এই বর্ষার আকাশ, এই ছায়াবেষ্টিত গ্রাম, এই জলধারা প্রফুল্ল শস্যের ক্ষেত ঘিরে দাঁড়িয়ে তাদের সত্যে ও সৌন্দর্যে সজীব করে তুলেছে।’

এই মুগ্ধতার রেশ নিয়ে চলছি বুড়ি পোতাজিয়া। বাইরে হালকা বৃষ্টি। বাঘাবাড়ী নৌবন্দর থেকে কিছু দূর এগোলেই বাঁ দিকে সরু পাকা রাস্তা। দুই পাশে আশ্রয়হারা মানুষের বাস। বাতাসে ধুলো নেই, নাকে লাগছে মাটির গন্ধ, চোখে সবুজের প্রশান্তি। এরপর লাউতারা স্লুইসগেট। সেখান থেকে ইঞ্জিন নৌকায় ১৫ মিনিটের যাত্রা। চলনবিল আসলে পানির রাজ্য। বিলের জলে ভাসতে থাকা নৌকাগুলো ছোট ছোট ঢেউয়ে দোল খাচ্ছে। দ্বীপের মতো জেগে আছে ছোট ছোট গ্রাম। গ্রামঘেঁষে যাওয়ার সময় ঘর থেকে উঁকি মারছে শিশুমুখ। বাড়ির সামনের বিলে ডুবসাঁতারে ব্যস্ত কিশোর।

banner

চলনবিলে নাটোরের বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া; পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর এবং সিরাজগঞ্জের তাড়াশ ও রায়গঞ্জ উপজেলার এক হাজার ৬০০টি গ্রাম রয়েছে। এই বিস্তীর্ণ বিলে আছে বিভিন্ন নামে ৩৯টি বিল, ১৬টি নদী, ২২টি খাল ও অসংখ্য পুকুর। চলনবিলের সুবিধাভোগী মানুষের সংখ্যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় এক কোটি। এ ছাড়া ১০৫ প্রজাতির দেশি মাছ, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, সাত প্রকারের উভচর প্রাণী, ৩৪ প্রজাতির পাখি, অসংখ্য প্রকারের জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী চলনবিল এলাকায় বসবাস করে। ‘ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া’র তথ্যমতে, ১৮২৭ সালে জনবসতি বাদ দিয়েই চলনবিলের জলমগ্ন অংশের আয়তন ছিল ৫৫০ বর্গমাইল।

তার প্রমাণ মিলল দুপুরে বুড়ি পোতাজিয়ায় নেমে। চারদিকে থইথই পানি। উথালপাথাল ঢেউ। ইঞ্জিনচালিত নৌকার মাঝি আব্দুর রহমান গিয়ে থামলেন কিছুটা উঁচু এক জায়গার পারঘেঁষে। বললেন, ‘এখানে চার একর জায়গা মাটি ভরাট করা হয়েছে। বছরে ছয় মাস এই এলাকা পানিতে ডুবে থাকে। শুনেছি এমন ১০০ একর ভরাট করা হবে। ব্রিজ, রাস্তা হবে।’

উঁচু ভূমিটুকুতে প্রস্তাবিত রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সাইনবোর্ড। তাতে লেখা– রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশের স্থায়ী ক্যাম্পাসের নির্ধারিত স্থান। জমির পরিমাণ ১০০ একর।

মজার ব্যাপর হলো, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে এসে কেবল লেখালেখিই করেননি। জড়িয়েছিলেন সামাজিক কর্মকাণ্ডেও। কৃষকের গোখাদ্যের অভাবের কথা শুনে তিনি বুড়ি পোতাজিয়া ও রামকান্তপুর মৌজার প্রায় এক হাজার ২০০ একর জমি দান করেছিলেন। তাতেই তৈরি হয় বিশাল বাথানভূমি, যেখানে আজও শত শত গরু চরে।

ঐতিহ্যবাহী সেই বুড়ি পোতাজিয়ায় ১০০ একরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের প্রকল্প শর্তসাপেক্ষে অনুমোদন করেছে সরকার। শর্ত– পরিবেশ ছাড়।

রবীন্দ্রনাথ জমি দিয়েছেন কৃষির জন্য, কৃষকের স্বচ্ছলতার জন্য। স্থানীয় কৃষক, জেলে, বিল রক্ষায় কাজ করা সংগঠনগুলোর আশঙ্কা, এখন রবীন্দ্রনাথের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো নির্মাণ বিলের জীববৈচিত্র্য ও প্রাণ-প্রকৃতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। বিলের পানি প্রবাহ, মিঠাপানির মাছের প্রজনন, কৃষি উৎপাদন– কোনো কিছুই এই প্রভাব থেকে মুক্ত থাকবে না। দীর্ঘ মেয়াদে চলনবিলের জলজ বাস্তুতন্ত্র ও কৃষি অর্থনীতির গলার কাঁটা হয়ে উঠবে প্রকল্পটি।

ভরাট করা সেই চার একর ভূমিতে নেমে দেখা গেল কয়েকজন জেলে মাছ ধরার জাল বুনছেন। কিছু ভেড়া, ছাগল, ঘোড়াও চরে বেড়াচ্ছে। কথা হলো জেলে আজিজুল হকের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘২০ বছর ধরে বিলে মাছ ধরে সংসার চালাচ্ছি। শুনছি বিলের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় হবে। কিন্তু রাস্তাঘাট তো কিছু নেই। ছয় মাস চারদিক পানি থাকে। কেমনে কী হবি জানি না।’

চলনবিল যেমন জীববৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আবার এখানকার মানুষের জীবনও বৈচিত্র্যে ভরা। শুকনা মৌসুমের মাইলের পর মাইল বিস্তীর্ণ সবুজ। ধান, সরিষা, পেঁয়াজ, রসুন– কী হয় না তখন। বর্ষায় একবারে ভিন্ন রূপ। থইথই পানি আর উথালপাথাল ঢেউ। ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতির মতো বদলে যায় বাসিন্দাদের কাজের ধরনও। আপাদমস্তক কৃষক হয়ে যায় পরিপূর্ণ জেলে। বিস্তীর্ণ এই এলাকায় ঋতু বদলের সঙ্গে পালা করে চলে কৃষি, মৎস্য ও পশুপালন।

বুড়ি পোতাজিয়ায় কেন ক্যাম্পাস

পদ্মা, আত্রাই, বড়াল, নন্দকুজা, গুমানীসহ সব নদনদী, খালবিল চলনবিলের পানির উৎস। এই বিশাল জলরাশি যমুনায় পতিত হওয়ার একমাত্র মুখ বুড়ি পোতাজিয়া। এখানেই রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত স্থান নির্ধারণ করেছে সরকার।

চলনবিল রক্ষা কমিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি স্থানান্তরের জন্য পরিকল্পনা ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে। চলতি মাসে পাবনার চাটমোহর প্রেস ক্লাবে চলনবিল রক্ষা আন্দোলন কমিটি সংবাদ সম্মেলন করেও একই দাবি জানিয়েছে। মন্ত্রণালয়ে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, ইতোমধ্যে বিলে বালু ফেলে ভরাট করা হয়েছে। এতে বিলের উৎসমুখ সংকুচিত হয়েছে। এই ভরাট চলতে থাকলে এবং সেখানে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হলে, গোটা চলনবিল জলাবদ্ধতাসহ নানামুখী বিপর্যয়ে পড়বে।

রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় আইন পাস হয় ২০১৬ সালে। ক্লাস শুরু হয় ২০১৮ সাল। শাহজাদপুর পৌরশহরের বিভিন্ন প্রান্তে আটটি ভাড়া ভবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম চলছে। শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবি স্থায়ী ক্যাম্পাস। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বুড়ি পোতাজিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ১০০ একর জমি নির্ধারণ করা হয়। স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণে প্রকল্প অনুমোদনের দাবিতে শিক্ষার্থীরা এর মধ্যে কয়েক দফা সড়ক অবরোধ করেছেন।

১৬ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রস্তাবিত স্থান পরিদর্শন করেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত স্থানটি বছরে চার মাস পানির নিচে থাকে। এটি ৯ মিটারের বেশি ভরাট করতে হবে। এ জন্য বালু লাগবে ৩৬ লাখ ৬১ হাজার ৬৩০ ঘনমিটার। ক্যাম্পাসে যাতায়াতের জন্য নির্মাণ করতে হবে সড়ক ও সেতু। পানির ঢেউ প্রতিরোধে দিতে হবে বাঁধ। এসবের জন্য ব্যয় হবে ৪৪৮ কোটি টাকা।

ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইতোমধ্যে চার একর জলাভূমি ভরাট করার কারণে বড়াল নদের পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বাকি ৯৬ একর ভরাট করা হলে বর্ষাকালে চলনবিল ও বড়াল নদের পানি প্রবাহ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পরিকল্পনা কমিশনকে দেওয়া ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বুড়ি পোতাজিয়ার চলনবিলের অংশে স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ যুক্তিযুক্ত হবে না বলে প্রতীয়মান হয়।’

নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকি বলেন, খোদ শাহজাদপুরেই বিকল্প অনেক জায়গা আছে যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস নির্মাণ করা যায়। সরকারকে সেদিকে নজর দেওয়া উচিত।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালে তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একনেকের সভায় ৯ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করেন। আট বছর পর একাধিক সংশোধন শেষে ১৭ আগস্ট একনেক সভায় পরিবেশ ছাড়পত্র নেওয়ার শর্তে ৫১৯ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষে প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়।

কৃষি, মৎস্য ও দুগ্ধ সম্পদ নিয়ে উদ্বেগ

সিরাজগঞ্জের বড়াল ও ধোলাই নদের মাঝে অবস্থিত বাথানভূমি এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ গোচারণভূমি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গোচারণভূমির জন্য জমি দান ছাড়াও উন্নতজাতের ষাঁড় এনে গাভির প্রজননের ব্যবস্থা করেন। ওই উত্তরাধিকার আজও বহমান। মূলত এই এলাকার দুধ দিয়েই চলছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান মিল্ক ভিটা। শুধু সিরাজগঞ্জ নয়, পাবনা, নাটোরসহ আশপাশের জেলাগুলোর খামারিদের জন্যও এই এলাকাটি গুরুত্বপূর্ণ।

সরেজমিন গিয়ে জানা গেল, প্রায় ১৫০০ একর জমিজুড়ে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় প্রায় ৩০ হাজার গো-খামার। এসব খামার থেকে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ লাখ লিটার দুধ উৎপন্ন হয়। সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী মিল্ক ভিটার পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান মনির বলেন, যে এলাকায় রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, সেটি বর্তমানে মিল্ক ভিটার আওতাধীন খামারিদের কাছে ঘাস উৎপাদনের জন্য লিজ দেওয়া হয়েছে। এই জমি অন্য কাজে ব্যবহৃত হলে গো-খাদ্যের উৎপাদন হ্রাস পেতে পারে। যা দুধ উৎপাদনের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে এবং খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বুড়ি পোতাজিয়ায় স্থাপনা নির্মাণ হলে চলনবিল, গোহালা ও বড়াল নদীর পতিত মুখ দিয়ে উজান থেকে নেমে আসা ছোট-বড় ৪৮টি নদীর পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে।

চাটমোহর উপজেলার ছাইখোলা ইউনিয়নের বোয়ালমারী গ্রামের জেলে আফজাল করিম বলেন, আমাদের সংসার চলে বিলের মাছ ধরে। বিলে আগের মতো ঠিক সময়ে পানি আসে না, আবার লম্বা সময় পানি থাকে না। তার ওপর যদি বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কারণে যমুনার পানি বিলে ঢুকতে না পারে, তাহলে মাছ ও পানি দুটিই ঠিকভাবে পাওয়া যাবে না।

স্থানীয় কৃষক আবদুল হান্নান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় দরকার, কিন্তু বিল ভরাট করে নয়। অন্য জমি খুঁজে সেখানে হোক। চলনবিল শুধু জমি নয়, আমাদের জীবন।

বিকল্প কী

পরিবেশবিদরা বলছেন, শাহজাদপুরের অন্য কোনো জায়গায় প্রস্তাবিত ক্যাম্পাসটি নির্মাণ করা যেতে পারে। প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণ করে ক্যাম্পাস নির্মাণ করা হোক। চলনবিল রক্ষা আন্দোলনের সদস্য সচিব এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক এস এম মিজানুর রহমান বলেন, অপরিকল্পিত উন্নয়নে এমনিতেই ঝুঁকিতে আছে চলনবিল। এখন এর কোলঘেঁষে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হলে কফিনে শেষ পেরেক মারার মতো অবস্থা হবে। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় হলে আশপাশে অন্য দখলদাররাও বিল ধ্বংসের বৈধতা পেয়ে যাবে। তিনি বলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে নই। আমরা শুধু চলনবিলকে বাঁচিয়ে এটা চাই।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক আতাউর রহমান বলেন, পানি আইনে বলা আছে, জলস্রোতের ধারা বাধাগ্রস্ত করে এমন কিছু করা যাবে না। একটা বিশ্ববিদ্যালয় হলে সেটার পরিবহন, যাতায়াত, আবাসনসহ জলজ প্রাণীর ক্ষতি হবে কিনা, পরিবেশগত প্রভাব কী হবে– সবকিছু একটা দক্ষ প্রতিষ্ঠান দিয়ে সমীক্ষা করা উচিত।

এ বিষয়ে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এস এম হাসান তালুকদার বলেন, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী শাহজাদপুরে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত জায়গায় ক্যাম্পাস স্থাপনের বাধ্যবাধকতা আছে। তাই স্থান পরিবর্তনের সুযোগ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত স্থান থেকে চলনবিল ৬৮ কিলোমিটার দূরে। তাই চলনবিলের ক্ষতি হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। প্রকল্পের কাজ শুরুর প্রতিটি পদক্ষেপে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন নিয়েই করা হবে।

সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) তথ্য অনুযায়ী, চলনবিলে ১৯৭৫ সালের মার্চে শুষ্ক মৌসুমে যেখানে ৮০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় পানি ছিল, ২০২৫ সালে এসে তা নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬৬ বর্গকিলোমিটারে; অর্থাৎ ৯২ শতাংশ এলাকায় পানি কমে গেছে।

সিইজিআইএসের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলনবিলে ১৫টি পোল্ডার নির্মাণ করা হয়েছে, যার ফলে এক হাজার ৫০০ কিলোমিটার বাঁধ এবং ১৮০টি স্লুইসগেট ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামো তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া এক হাজার ১৮৮টি সড়ক নির্মাণ হয়েছে। এসব কারণে নদনদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে, বিলের চরিত্র নষ্ট হয়েছে এবং অনেক এলাকা মূল প্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

প্রতিবেদন বলছে, ২০১৪ সালের আগে চলনবিলে মাছের উৎপাদন ছিল ২৬ হাজার ৯৯০ টন, যা এখন কমে দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৯৯৯ টনে। দেশি মাছের প্রজাতি ১০৫ থেকে নেমে এসেছে ষাটে।

এমন পরিস্থিতিতে চলনবিলকে ‘পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ ঘোষণা করে সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) রাজশাহী বিভাগের সমন্বয়ক তন্ময় কুমার সান্যাল। তিনি বলেন, চলনবিল উদ্ধার ও রক্ষায় একটি ‘চলনবিল কর্তৃপক্ষ’ গঠন করতে হবে। অপরিকল্পিত বাঁধ ও স্লুইসগেট অপসারণ, সিএস রেকর্ড অনুযায়ী নদী, খাল ও জলাশয়ের সীমানা নির্ধারণ করে দখলমুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি বর্জ্য ফেলা বন্ধ করতে হবে।

সিইজিআইএসের নির্বাহী পরিচালক ফিদা এ খান বলেন, জলাভূমি ভরাট করে উন্নয়ন প্রকল্প প্রচলিত পরিবেশ আইনে নিষিদ্ধ। ইছামতী নদী উদ্ধার আন্দোলনের সভাপতি এস এম মাহবুব আলম বলেন, চলনবিলের সঙ্গে ইছামতী নদীর সংযোগ রয়েছে। একদিকে ৫৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ইছামতী নদী খনন চলছে, অন্যদিকে পোতাজিয়ায় চলনবিলের মুখে ১০০ একর জমি ভরাট করার আয়োজন চলছে। এটা স্ববিরোধী। বিলের মুখ বন্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস করা অযৌক্তিক।

স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, রবীন্দ্রনাথের কল্পনাকে সজীব করা সেই রৌদ্র-বৃষ্টি, নদীস্রোত আর শস্যভরা ক্ষেত কি টিকে থাকবে, নাকি কংক্রিটের ভিড়ে হারিয়ে যাবে। সরকারকেই এর সুরাহা করতে হবে।

বিষণ্ন ফেরা

বিলে ঘুরতে ঘুরতে সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ল। বিলের বিশালতা পেছনে ফেলে আবার গ্রামঘেঁষে চলতে থাকে নৌকা। হেলে পড়া সূর্যের কিরণ চিকচিক করছে পানির গায়ে। নৌকাগুলো আস্তে আস্তে বাঁধা পড়ছে বাড়ির ঘাটে। সারি ধরে ঘরে ফিরছে হাঁসের দল। কী অপার্থিব বিলের এই রূপ! মানসপটে ভেসে ওঠে রবীন্দ্রনাথ। শাহজাদপুর সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘এখানকার দুপুর বেলাকার মধ্যে বড়ো একটি নিবিড় মোহ আছে। রৌদ্রের উত্তাপ, নিস্তব্ধতা, নির্জনতা, পাখিদের বিশেষত কাকের ডাক, এবং সুদীর্ঘ সুন্দর অবসর–সবসুদ্ধ জড়িয়ে আমাকে ভারি উদাস ও আকুল করে।’ (ছিন্নপত্র)।

এই রবীন্দ্র-আবেশ ছিন্ন করে আবার গাড়িতে চেপে বসা। পিচঢালা পথ ধরে ফিরে আসা কংক্রিটের শহরে। মনের ভেতর প্রার্থনার সুর– চলনবিলে রবীন্দ্রনাথ আর রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় যেন মুখোমুখি না দাঁড়ায়।

এই সম্পর্কিত আরো পোস্ট দেখতে পারেন

কমেন্ট লিখুন