চলনবিলকে অচল করে দিয়ে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় করা যাবে না। রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস করতে হবে চলনবিলকে বাঁচিয়ে। বিকল্প স্থানে বিশ্ববিদ্যালয় কাম্প্যাস প্রতিষ্ঠা করার দাবি করেছে দেশের পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে ২২টি পরিবেশ ও সামাজিক সংগঠন সংবাদ সম্মেলন করে এই দাবি জানায়। ‘চলনবিলে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ: ঝুঁকি ও বিকল্প পরিকল্পনা’ শীর্ষক এই সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সভাপতি অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ তালুকদার।
লিখিত গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন চলনবিল রক্ষা আন্দোলনের সদস্যসচিব এস এম মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, চলনবিলের শাহজাদপুর উপজেলার বুড়ি পোতাজিয়া এলাকায় ১০০ একর জায়গায় ৯ থেকে ১৪ মিটার উচ্চতার বালু ভরাট করে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। শুধু বালি ভরাটের জন্যই ৪৪৮ কোটি টাকা বরাদ্দ ধরা হয়েছে। এ ছাড়া নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৫১৯ কোটি টাকা। কেবল বালি ভরাটের অর্থেই শাহজাদপুরের আশপাশে উঁচু জমি কিনে ক্যাম্পাস করা যায়। বিকল্প হিসেবে তিনি রবীন্দ্র কাছারিবাড়ির আশপাশে কবির জমিদারির দখল হয়ে যাওয়া সম্পত্তি উদ্ধার বা হুকুম দখলের মাধ্যমে কিনে সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় ভবন নির্মাণের বিকল্প প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এ ছাড়া দ্বিতীয় বিকল্প হিসেবে সিরাজগঞ্জে অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য যে ১ হাজার ১৫৬ একর জমি আছে, সেখানেও একটি সুবিধাজনক অংশে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় করা যেতে পারে। অথবা বিকল্প হিসেবে সরকার অন্য কোনো সুবিধাজনক স্থান বেছে নিতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
গবেষণাপত্রে বলা হয়, চলনবিল উত্তরাঞ্চলের ৬টি জেলার ৩৬টি উপজেলাজুড়ে বিস্তৃত। এর আয়তন প্রায় ১ হাজার ৮৮ বর্গকিলোমিটার। এই বিশাল বিলে পদ্মা, যমুনাসহ ৪৭টি নদ-নদীর পানি প্রবাহিত হয়। চলনবিল অঞ্চলে ছোট-বড় মোট বিল আছে ১৬৩টি, খাল তিন শতাধিক, পুকুর আছে ১ লাখ ২০ হাজার। এ ছাড়া বিশাল আকারের পাথার আছে অন্তত চারটি। চলনবিলে ১০৫ প্রজাতির দেশি মাছ, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৭ প্রকারের উভচর প্রাণী, ৩৪ প্রজাতির পাখিসহ বহু প্রজাতির স্থলজ ও জলজ উদ্ভিদ রয়েছে। চলনবিল দেশের এক অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদ। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এক কোটির বেশি মানুষ চলনবিলের সঙ্গে জীবিকায় যুক্ত।
গবেষণাপত্রে বলা হয়, বুড়ি পোতাজিয়া এলাকাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি চলনবিলের সঙ্গে যমুনার পানির সংযোগস্থল। এ স্থানটিতে উঁচু করে ভরাট করা হলো বিলের পানিপ্রবাহ ব্যাহত হবে। এতে সমগ্র চলনবিল এলাকায় মারাত্মক প্রভাব পড়বে। বিলের প্রাণবৈচিত্র্য বিপন্ন হবে। এখানে বিল ভরাট করা ২০০০ সালের জলাশয় রক্ষা আইনের বিরোধী এবং ২০১৩ সালের পানি আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। পানি আইনের ২০ ধারায় স্পষ্টভাবে পানিপ্রবাহ বন্ধ করে সব ধরনের স্থাপনা নির্মাণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়া দেশের উচ্চ আদালত নদ-নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। অথচ এখন যিনি রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করছেন, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক ছিলেন। এসব আইন তাঁর ভালোভাবেই জানার কথা। তাঁর কাছে প্রত্যাশা যে তিনি আইন লঙ্ঘন করে কোনো কিছু করতে উদ্যোগী হবেন না। ছাত্রদের বিষয়টি বুঝিয়ে বলবেন।
সংবাদ সম্মেলনে নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী প্রধান জাকির হোসেন বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বদরবারে পৌঁছে দিয়েছেন। তিনি আমাদের গর্ব। আরও আগেই তাঁর নামে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া উচিত ছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর স্মৃতিবিজড়িত স্থানের কাছাকাছি হওয়াটাই অধিক যুক্তিসংগত। কিন্তু কাছারিবাড়ি থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার দূরে প্রকৃতি ও পরিবেশগত খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল স্থাপনা নির্মাণ কিছুতেই যুক্তিযুক্ত হবে না।’
সভাপতির বক্তব্যে বাপার সভাপতি অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ তালুকদার বলেন, ‘আমরা রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধী নই। আমরাও রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় চাই। এর সঙ্গে আমাদের কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু চলনবিল ও প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হবে। এই পদ্মা দিয়েই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বোটে ভ্রমণ করেছেন। চলনবিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তিনি তাঁর কাব্য–সংগীত–সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। এখনে সেই প্রকৃতিকে ধ্বংস করে স্থাপনা নির্মাণ রবীন্দ্র চেতনার ও আদর্শের সঙ্গেও বিরোধপূর্ণ। কাজেই রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় বিকল্প কোনো স্থানে নির্মাণ করা আবশ্যক।’
সংবাদ সম্মেলন সঞ্চালনা করেন বাপার সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো চূড়ান্ত জমি স্বল্পতার দেশে বিপুল জায়গা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস নির্মাণের প্রবণতা থেকে সরে আসতে হবে। দেশে অনেক বেসরকরি বিশ্ববিদ্যালয় স্বল্প জায়গার মধ্যে আধুনিক স্থাপত্যরীতিতে উঁচু ভবন নির্মাণ করেছে। সেগুলো দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রহণ করা প্রয়োজন।
সংবাদ সম্মেলনে বিভন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা বক্তব্য দেন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, চলনবিল রক্ষা করে বিকল্প স্থানে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস করার দাবি নিয়ে ২২টি সংগঠনের পক্ষ থেকে পরিবেশবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে স্মরকলিপি পেশ করা হবে।
সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেয় বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), চলনবিল রক্ষা আন্দোলন, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি), নাগরিক উদ্যোগ, বারসিক, বাদাবন সংঘ, ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ (ডব্লিউবিবি ট্রাস্ট), পরিবেশ বার্তা, কোস্টাল ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ (সিডিপি), গ্রীন ভয়েস, গ্রীন সেভার্স, চিলড্রেন ওয়াচ ফাউন্ডেশন (সিডব্লিউএফ), কোয়ালিশন ফর আরবান পুওর (কাপ), উন্নয়ন ধারা ট্রাস্ট, ক্যাপস, তিস্তা নদী রক্ষা কমিটি, নদী পক্ষ, বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশন, নদী পরিব্রাজক দল, রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি), এএসডিএস, সোসাইটি ম্যানেজমেন্ট ফাউন্ডশেনসহ ২২টি পরিবেশ ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান।
“সুত্র: প্রথম আলো”