নুরুল ইসলাম রইসী,সিরাজগঞ্জ (বিশেষ প্রতিনিধি):
জেলার কাজীপুর উপজেলার গান্দাইল ইউনিয়নের একটি গ্রাম বড়ইতলা। এ গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ আহলে হাদীস আনুসারী। ইসলামি অনুশাসন মেনে জীবন পরিচালনার ব্যাপারে তারা আপোষহীন। ইসলাম গর্হিত অনুশাসন কিংবা অন্যায় অনৈতিক কাজে তারা জড়াতে চায় না।
ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ আমলে একতরফা ভোটের কেন্দ্রে না যেতে চাওয়া, আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেম্বর প্রার্থী ইসমাইল হোসেনকে ভোট না দেয়া এবং কট্টর আহলে হাদীস অনুসারী নারীদের পর্দা মেনে চলা, ব্যক্তি জীবনে ইসলামি অনুশাসন মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করতে কুরআন হাদিসের তালিমি বৈঠক করা ইত্যাদি কারণে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের রোষানলে পরে বিভিন্ন ভাবে নির্যাতনের শিকার হন এখানকার আহলে হাদীস সম্প্রদায় সহ ইসলাম পন্থী জনগণ।
এরই ধারাবাহিকতায় বরইতলা গ্রামের কৃষক আবু সাইদ সহ পাঁচ পরিবারে নেমে আসে জাহেলিয়াতের বর্বর নির্যাতন।
গাজীপুরের পাতারটেক এলাকায় জঙ্গি নাটক সাজিয়ে যে সাতজনকে হত্যা করা হয় সেই সাতজনের মধ্যে একজন ছিল এই বরইতলা গ্রামের কৃষক আবু সাইদের বড় ছেলে ফরিদুল ইসলাম আকাশ। খবর পেয়ে পরিবারের পক্ষে এলাকার জনপ্রতিনিধিসহ কয়েকজন আকাশের লাশ গ্রহণ করতে জয়দেবপুর থানায় গেলেও লাশ না দিয়ে তাদের ফেরত পাঠায় পুলিশ। পরে বেওয়ারিশ হিসেবে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে গাজীপুরেই লাশ দাফন করে পুলিশ।
পরিবারের একমাত্র শিক্ষিত ছেলে আকাশ চাকুরির জন্য ঢাকায় গিয়ে প্রথমে নিখোঁজ পরে জঙ্গি সাজিয়ে পুলিশ তাকে হত্যা করে লাশ বাবা মা’র কাছে ফেরত না দেয়ার যে কষ্ট তা আজও ভূলতে পারেনি জনম দূঃখিনী মা ফুলেরা বেগম।
প্রতি রাতেই তাহাজ্জত নামাজ শেষে নিষ্পাপ ছেলের জন্য আহাজারি করেন এবং হত্যাকারীদের যেন বিচার হয় তার জন্য মহান আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানান।
সরেজমিনে বরইতলা গ্রামের দরিদ্র কৃষক আবু সাইদের ছেলে গাজীপুরের পাতারটেকে জঙ্গি নাটকে নিহত ফরিদুল ইসলাম আকাশের হতভাগ্য মা ফুলেরা বেগম সহ অন্যান্য ভুক্তভোগীরা এসব তথ্য নিশ্চিত করেন।
জঙ্গি নাটকে নিহত আকাশের মেজো চাচা জাহাঙ্গীর আলম জানান, গান্দাইল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করে সিরাজগঞ্জ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে কম্পিউটার ইন্জিনিয়ারিং ডিপ্লোমা সম্পন্ন করে দরিদ্র বাবার সংসারের হাল ধরতে চাকুরির খোঁজে ঢাকায় যায়। এরপর হঠাৎ বাড়িতে ডিবি পুলিশ এসে আকাশের খোঁজ নিতে থাকে। এক পর্যায়ে ডিবি পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যায়। ডিবি হেফাজতে পাঁচদিন জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আমাকে ছেড়ে দেয়।
আকাশের মা ফুলেরা বেগম বলেন ‘৫ আগস্ট ২০১৬ সাল। শুক্রবার দুপুরে পুলিশ আমাদের বাড়ি ঘিরে ফেলে। বাড়ির ভিতরে এসে আকাশের খোঁজ করতে থাকে। হুমকি ধামকি ও ভয়ভীতি দেখায়। পুলিশ জানায়, আকাশ নাকি জঙ্গির খাতায় নাম দিছে। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে আমাদের। এক পর্যায়ে ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণিতে পড়া দুই মেয়ে আমাকে ধরে নিয়ে যায় সিরাজগঞ্জের ডিবি অফিসে। সেখানে মহিলা পুলিশ দিয়ে আমাদের মারপিট করে। গোসল করতে পারতাম না। এভাবে ডিবি অফিসে কয়েকদিন নির্যাতন করে এক রাতের অন্ধকারে জেলখানার গাড়িতে করে আমাদের কোথায় যেন নিয়ে যায়। রাতের বেলা গাড়ি থেকে নামিয়ে পায়ে হেঁটে নিচের দিকে সিড়ি দিয়ে নামিয়ে ছোট্ট একটা স্যাতস্যাঁতে দুর্গন্ধময় চিপা রুমের মধ্যে রাখে। ওই রুমে এক মাস থেকেছি। আমরা নাকি জঙ্গি। ওখানে আমাদের সাথে অমানবিক জুলুম করা হয়েছে। একমাস গুম ঘরে থাকার পর কোনো এক মধ্য রাতে ছেড়ে দেয়ার কথা বলে গাড়িতে করে আমাদেরকে বাড়িতে নিয়ে আসে। বাড়ির আঙিনায় গাড়ি থামিয়ে আমাদের গাড়িতে রেখেই পুলিশ বাড়ির ভিতরে যায়। ঘর বাড়ি তছনছ করে পুলিশ বাড়ির বাইরে গাড়ির কাছ আসে। এরপর মধ্য রাতে প্রতিবেশী লোকজনকে ঘুম থেকে ডেকে এনে তাদের সামনে আমাদের সাথে নিয়ে ঘরে তল্লাশি চালিয়ে(ওদের রাখা) জিহাদী বইপত্র আর দেশি অস্ত্র উদ্ধারের নাটক করে সাদা কাগজে প্রতিবেশীদের সই স্বাক্ষর নিয়ে আমাদের গ্রেফতার দেখিয়ে আবার নিয়ে যায়। পরেরদিন ডিবি অফিসে সাংবাদিক ডেকে ক্যামেরায় ছবি তোলে এবং আমাদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে ৬ দিনের রিমান্ড দেয়। রিমান্ডে অমানবিক নির্যাতন করে। রিমান্ড শেষে জেল হাজতে দেয়। ক্লাস সিক্সে পড়ুয়া ছোট মেয়ে সালমাকে রাজশাহী সেফহোমে পাঠায়। ফুলেরা বেগম আরো বলেন, জেল হাজতে থাকা অবস্থায় গাজীপুরে আমার ছেলে আকাশকে জঙ্গি নাটক সাজিয়ে হত্যা করে সেই খবর পাই। এরপর ১৭ মাস হাজত খেটে জামিনে বের হয়ে আসি।
জঙ্গি তকমা দিয়ে দুই শিশু মেয়ে সহ ফুলেরা বেগমকে যেদিন ধরে নিয়ে যায় সেই দিন মধ্যরাতে একই গ্রামের কাঠমিস্ত্রি রফিকুল ইসলাম ও তার স্ত্রী রাজিয়া খাতুনকে এবং আরো এক বাড়ি থেকে আজীজ কর্মকারের স্ত্রী আকলিমা খাতুনকে জঙ্গি তকমা দিয়ে ধরে নিয়ে যায় ডিবি পুলিশ।
জঙ্গি তকমা দিয়ে ধরে নেয়া আকাশের মা ফুলেরা বেগম, ফুলেরা বেগমের শিশু মেয়ে শাকিলা ও সালমা, অন্য পরিবারের রফিকুল ইসলাম ও তার স্ত্রী রাজিয়া খাতুনকে সিরাজগঞ্জের একটি গুম ঘরে এক মাস আটকে রেখে নির্যাতন করে বলে ভিকটিমরা জানান। অন্যদিকে একই গ্রামের আরো এক পরিবারের আকলিমা খাতুনকে বগুড়াতে রাখা হয়েছিল বলে ভুক্তভোগী আকলিমা জানিয়েছেন।
কেন এই জুলুম-নির্যাতন করা হয়েছে জিজ্ঞাসা করা হলে রাজিয়া খাতুন বলেন, কেন যে এই নির্যাতন করা হয়েছে তা আল্লাহ ই ভালো জানেন। তবে আমরা পর্দা করি, অন্যায় ও অনৈতিক কাজ পছন্দ করি না। আমরা কুরআন হাদিসের তালিমি বৈঠক করতাম। আমরা ইসলাম পন্থী। আওয়ামী লীগের সাথে আমাদের বিরোধ, আমরা ভোট কেন্দ্রে যেতে চাই নাই।
একই রকম কথা জানান বরইতলা গ্রামের আজীজ কর্মকারের মেয়ে আকলিমা খাতুন।
প্রতিবেশী মর্জিনা খাতুন সে দিনের দুঃসহ স্মৃতির কথা উল্লেখ করে কেঁদে ফেলেন। তিনি বলেন ‘আমরা শুধু দেখলাম বিনা অপরাধে দুই বছরের বাচ্চার গগণ বিদারী কান্না উপেক্ষা করে
ফুলেরাদের ধরে নিয়ে গেল। নেয়ার পর কোথায় ওদের রাখল, বাঁচলো না মরলো কিচ্ছু জানিনা। কারো কোনো কথা বলার সাহস নাই। কয়েক মাস পর সন্ধ্যান পাইলাম ওরা জেলখানায় আছে। অনেক কষ্ট করে নানা প্রটোকল মেইনটেন করে দেখা করে আসলাম।’
ভুক্তভোগীদের প্রতিবেশী আনছার আলী ও মুকুল হোসেন
জানান, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা প্রতিহিংসা বশত এই পরিবারগুলোকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে জঙ্গি সাজিয়ে বর্বর নির্যাতন করছে। এরজন্য দায়ীদের আমরা বিচার চাই।
ভুক্তভোগী সবাই জানান ‘সিরাজগঞ্জ ডিবি অফিসার রওশন আলী, ইয়াসির আরাফাত ও নুরু এই তিনজন অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও নির্দয় নির্মম নির্যাতন চালিয়েছে আমাদের ওপর। এরা আওয়ামী দোসর। এরা সিরাজগঞ্জে না থাকলেও অন্য কোথাও চাকুরী করছেন। গান্দাইল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা নজরুল ইসলাম ওরফে নজির মাষ্টার, ইসমাইল হোসেন মেম্বর, ইমরুল মোহসীন সহ স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের কথামত মিথ্যা বানোয়াট তথ্যের ভিত্তিতে উপরোক্ত ডিবি পুলিশ জঙ্গি নাটক সাজিয়ে আওয়ামী মতের বিরোধী ইসলাম পন্থীদের ওপর বর্বর এই নির্যাতনের হোতাদেরকে আইনের আওতায় এনে তদন্ত করে বিচারের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করার জানান তারা।
এদিকে কৃষক আবু সাইদ ও ফুলেরার বড় ছেলে ফরিদুল ইসলাম আকাশকে ঢাকা থেকে অপহরণ করে জঙ্গি সাজিয়ে
অন্য এলাকার আরো কয়েকজনের সাথে আটকে রেখে জঙ্গি নাটক বানিয়ে পুলিশের সাথে গোলাগুলির ঘটনা সাজিয়ে ফুলেরার ছেলে আকাশ সহ সাতজনকে হত্যা করা হয়।
খবর পেয়ে পরিবারের পক্ষে গান্দাইল ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের মেম্বর আসাদুল ইসলাম সহ কয়েকজন আকাশের লাশ গ্রহণ করতে জয়দেবপুর থানায় গেলেও লাশ না দিয়ে তাদের ফেরত পাঠায় পুলিশ। পরে বেওয়ারিশ হিসেবে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে গাজীপুরেই লাশ দাফন করে পুলিশ। পরিবারের লোকজন লাশের অপেক্ষায় থাকলেও মন গলেনি পাষন্ডদের।
এই ঘটনার পেছনে কারা কলকাঠি নেরেছে- জনপ্রতিনিধি হিসেবে আপনি কি জেনেছেন- উত্তরে স্থানীয় মেম্বর আসাদুল ইসলাম বলেন, ‘আকাশ ছেলেটা অত্যান্ত নম্রভদ্র ছিল। আমার জানামতে নির্যাতিতদের কোনো অন্যায় ছিল না। উপরের নির্দেশে পুলিশ এসব করেছে।’
অভিযুক্ত স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নজরুল ইসলাম ওরফে নজির মাষ্টার ও ইসমাইল হোসেন মেম্বর সহ অন্যরা বর্তমানে পলাতক থাকায় তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে উপরোক্ত ঘটনা তদন্ত পূর্বক দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল।