কর্মসংস্থানমুখী শিক্ষায় জোর দিচ্ছে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। চাকরির বাজারে যেসব বিষয়ের চাহিদা আছে, সে বিষয়গুলো তাদের পাঠ্যক্রমে যুক্ত হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত বিষয়গুলোতে এখন শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বেশি। সেদিকেও মনোযোগ দিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
দেশের ১১৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১০৪টিতেই প্রকৌশল বিষয় পড়ানো হয়। এর মধ্যে ব্র্যাক, নর্থ সাউথ, ইন্ডিপেনডেন্ট, ইউনাইটেড, ইস্ট ওয়েস্ট, আহ্ছানউল্লা, ড্যাফোডিল, এআইইউবিসহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৌশল বিষয়ে ভর্তির লড়াইটাও বেশ তীব্র।
বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশল বিষয়ে শিক্ষার্থীদের চাহিদার শীর্ষে রয়েছে পুরকৌশল, স্থাপত্যবিদ্যা, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই), কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই), যন্ত্রকৌশল, টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং এবং টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং।
শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুযায়ী আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই), এজেন্টিক এআই, রোবটিকস, ডেটা সেন্টার ম্যানেজমেন্ট, সাইবার সিকিউরিটি ও সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট বিষয়ে বিশেষ কোর্স চালু করেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। একই সঙ্গে অনলাইন ও হাইব্রিড শিক্ষা মডেল শিক্ষার্থীদের বৈশ্বিক বাস্তবতার সঙ্গে পরিচিত করার চেষ্টাও চলছে।
গত কয়েক বছরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নতুন নতুন বিভাগ চালু করেছে। এর মধ্যে রয়েছে– ব্যাচেলর অব রিয়েল এস্টেট, এন্টারপ্রেনারশিপ ডেভেলপমেন্ট, নার্সিং অ্যান্ড হেলথ সায়েন্স, ফার্মাসি, বিজনেস অ্যানালাইটিক্স, ফিনটেক্স (ফিন্যান্স অ্যান্ড টেকনোলজি) এবং ইন্স্যুরেন্স অ্যান্ড রিচ ম্যানেজমেন্টের মতো বিষয়।
কর্মসংস্থানমুখী জ্ঞান অর্জনের কারণে এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা উচ্চ বেতনে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন।
তিন দশকের বেশি সময় পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভালো করলেও সব বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা এক নয়। বর্তমানে ১৫ থেকে ২০টি বিশ্ববিদ্যালয় ভালো করছে। এগুলোতে মানসম্পন্ন শিক্ষক, অবকাঠামো, ল্যাব, ল্যাবরেটরি, খেলার মাঠসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা আছে। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা চাকরির বাজারে ভালো করছেন।
নতুন কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ও ভালো করার চেষ্টা করছে। আবার কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা নাজুক। শিক্ষার্থীদের জন্য ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা, মানসম্পন্ন শিক্ষক সেখানে নেই। আবার কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ নিয়ে কিছু অভিযোগও রয়েছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতি ও অর্জন কী জানতে চাইলে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) সাবেক উপাচার্য ও বর্তমানে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের অধ্যাপক ড. এম রিজওয়ান খান বলেন, শুরুতেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রহণযোগ্যতার চ্যালেঞ্জ ছিল। সেই চ্যালেঞ্জটা অনেকটাই কেটে গেছে।
এম রিজওয়ান খান বলেন, অনেক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও কিছু বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শিক্ষার মানের পরিপ্রেক্ষিতে এগিয়েছে। স্বনামধন্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কিউএস র্যাঙ্কিং এবং টাইমস হায়ার এডুকেশন র্যাঙ্কিংসহ অন্যান্য আর্ন্তজাতিক মানদণ্ডে সামনের দিকে আছে। তারা মানসম্মত প্রফেশনাল তৈরি করছে, মৌলিক গবেষণা কার্যক্রমেও অবদান রাখছে।
তিনি বলেন, এখনও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বৈষম্যের শিকার; যেমন– অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও তারা সরকারি করের আওতামুক্ত নয়। মাত্র একটি বিশ্ববিদ্যালয় পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়ার অনুমোদন পেয়েছে। শিক্ষার স্বার্থে বৈষম্য যথাসত্বর দূর করতে হবে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাহিদাভিত্তিক যুগোপযোগী বিষয় এবং পাঠ্যক্রম প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বিশেষ করে ল্যাবরেটরি সায়েন্স, ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, কম্পিউটার অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম, মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং, তথ্য ও যোগাযোগ (আইসিটি), ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট, গ্রাফিকস ডিজাইন এবং পারফর্মিং আর্টসের মতো বিষয়গুলো চালু করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কো-কারিকুলার এবং এক্সট্রা-কারিকুলারের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করছেন। বিভিন্ন ক্লাবের মাধ্যমে তারা কমিউনিকেশন ও নেটওয়ার্কিং স্কিল অর্জন করেন, যা তাদের চাকরির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারেন। তিনি বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরা বেশ স্মার্ট হন। ইংরেজিতে কথা বলা থেকে শুরু করে তারা জানেন, কীভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে হয়। ফলে চাকরির বাজারে তারাই ডমিনেট করছেন।
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম আর কবির বলেন, বিশ্বখ্যাত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ড, কেমব্রিজ, অক্সফোর্ডসহ অনেকে বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশেও তাই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শীর্ষে উঠে আসা সময়ের ব্যাপার। ইতোমধ্যে ড্যাফোডিলসহ বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিংয়ে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান অর্জন করেছে। উচ্চমানের শিক্ষা নিশ্চিতকরণ, যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ এবং গবেষণার প্রসার ঘটিয়ে এই অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে।
সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছে কলা অনুষদের বিষয়গুলোও
বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি, ব্যবসায় শিক্ষার পাশাপাশি কলা অনুষদের বিষয়গুলোতেও উচ্চশিক্ষা দিচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। গবেষণায়ও এগিয়ে আসছে তারা। চলতি বছর প্রথমবারের মতো ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টর অব ফিলোসফি (পিএইচডি) চালু হয়েছে।
তিনটি অধিভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় বাদে দেশে পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় সমান। দৃষ্টিনন্দন ক্যাম্পাস, মানসম্পন্ন শিক্ষক, ল্যাবরেটরি, লাইব্রেরি সুবিধা ও নিয়মানুবর্তিতায় তারা অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে পেছনে ফেলেছে।
সর্বশেষ র্যাঙ্কিংয়েও শীর্ষে তিন বিশ্ববিদ্যালয়
গত ২৭ জানুয়ারি প্রকাশিত শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েবমেট্রিক্সের র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শীর্ষ দশে সাত সরকারি ও তিন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান করে নিয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে শীর্ষে (দেশে তৃতীয়)।
ওয়েবমেট্রিক্সের প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় (বৈশ্বিক র্যাঙ্কিং ১৭৭০) তৃতীয় অবস্থানে আছে। চতুর্থ অবস্থানে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি (বৈশ্বিক র্যাঙ্কিং ১৭৮৩), পঞ্চম অবস্থানে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (বৈশ্বিক র্যাঙ্কিং ১৮১৮)।
এই র্যাঙ্কিং প্রণয়নে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষণ পদ্ধতি, বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রভাব, নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ, অর্থনৈতিক প্রাসঙ্গিকতাসহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত ভূমিকা বিবেচনা করে মাদ্রিদভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠান। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক ওয়েবসাইটের কনটেন্ট ছাড়াও তাদের গবেষক ও প্রবন্ধ বিবেচনায় নিয়ে এ তালিকা তৈরি করা হয়।
কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এইচ এম জহিরুল হক বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা গ্র্যাজুয়েটরা নাসা, গুগল, মাইক্রোসফট, বিশ্বব্যাংক ইত্যাদি সংস্থায় চাকরি করছে। এই গ্র্যাজুয়েটদের অনেকে স্টার্টআপ; যেমন– পাঠাও, চালডাল, সাটেলসহ অনেক সফল কোম্পানির উদ্যোক্তা হয়েছে।