Home » উত্তরা ইপিজেড শ্রমিক অসন্তোষ, সংঘর্ষ একজন নিহত

উত্তরা ইপিজেড শ্রমিক অসন্তোষ, সংঘর্ষ একজন নিহত

0 মন্তব্য গুলি 4 জন দেখেছে 4 মিনিট পড়েছেন

নীলফামারী সংবাদদাতা:

উত্তরা ইপিজেডে শ্রমিক অসন্তোষের জেরে সড়ক অবরোধ করেন বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা। এ সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ চলাকালে মো. হাবিব ইসলাম (২১) নামের এক শ্রমিক নিহত হন।  মঙ্গলবার সকালে ইপিজেডের সামনের সড়কে এ ঘটনা ঘটে।

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, নিহত হাবিব ইকু ইন্টারন্যাশনাল নিটিং নামের একটি কারখানার শ্রমিক ছিলেন।

তিনি জেলা সদরের সংগলশী ইউনিয়ের কাজীরহাট মাছিরচাক গ্রামের মো. দুলাল হোসেনের ছেলে। এ ঘটনায় আহত সাতজনকে নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গুরুতর আহত তিনজনকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে।

banner

শ্রমিকদের ভাষ্য, ইপিজেডে এভারগ্রিন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ৫১ জন শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়।

এ নিয়ে তিন দিন ধরে শ্রমিক অসন্তোষ চলছে। এমন পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের আগস্ট মাসের বেতন-ভাতা পরিশোধ না করে গতকাল এভারগ্রিনের কারখানা হঠাৎ করে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কাজে যোগ দিতে এসে কারখানা বন্ধের নোটিশ দেখে বিক্ষুুব্ধ শ্রমিকরা সকাল ৮টার দিকে ইপিজেডের সামনের সড়কে অবস্থান নেন। এতে নীলফামারী-সৈয়দপুর সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

এ সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের সড়ক থেকে সরিয়ে দিতে গেলে সংঘর্ষ বাধে এবং ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার চলে। এক পর্যায়ে হাবিব ইসলাম ঘটনাস্থলে নিহত হন। এ ঘটনায় অন্তত ১০ জন শ্রমিক আহত হন। তাঁদের মধ্যে সাতজনকে নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

চিকিৎসাধীন ব্যক্তিরা হলেন মো. মোমিনুর রহমান (২৫), মো. শাহিন (২৬), নূর আলম (৩০), মোস্তাক আহমেদ (২৫), লিপি আক্তার (২৬), জমিলা খাতুন (৩৫) ও শামীম হোসেন (৩৫)।

গুরুতর আহত লিপি আক্তার, শাহিন ও শামীমকে পরে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে।

নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ফারহান তানভিরুল ইসলাম বলেন, ‘সকাল সাড়ে ৮টার দিকে হাবিবুর রহমানকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। এ ছাড়া আহত সাতজনের মধ্যে তিনজনকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।’

নিহত হাবিব ইসলামের বড় ভাই আশিকুর রহমান (২৪) অভিযোগ করেন, ‘আমার ভাই ইকু ইন্টারন্যাশনাল নিটিং কারখানায় রাতে কাজ করেছে। সে আন্দোলনে ছিল না। কাজ শেষে সকালে ইপিজেড থেকে বের হওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে নিহত হয়।’

হাবিবের বাবা মো. দুলাল হোসেন বলেন, ‘২০২৩ সালে আমার ছেলে হাবিব এসএসসি পাস করে ইপিজেডের ওই চাকরিতে যোগ দেয়। সোমবার মাগরিবের সময় খাওয়ার পর ডিউটির জন্য বাড়ি থেকে কারখানায় যায়। সকালে তার বাড়ি ফেরার কথা ছিল, এর মধ্যে খবর পাই গুলিতে ছেলে মারা গেছে।’

একই কারখানায় রাতে কাজ করেছিলেন সদর উপজেলার সোনারায় ইউনিয়নের ফকিরগঞ্জ গ্রামের মিলন ইসলাম (২৫)। তিনি বলেন, ‘সকালে ছুটি হলে হাবিবসহ আমরা একসঙ্গে অনেক শ্রমিক বেরিয়ে আসছিলাম। সামনে অবরোধ থাকায় কারখানার কর্মকর্তারা আমাদের সতর্কতার সঙ্গে বের করে দিচ্ছিলেন। এরই মধ্যে হাবিব গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে নিহত হন।’

এলাকাবাসী জানায়, গতকাল সকাল থেকে ইপিজেড এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য ইপিজেডের সামনে অবস্থান নেন। এ সময় গুলির শব্দ হলে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। দুপুর ১২টা পর্যন্ত দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলে। দুপুর আড়াইটার দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সড়কে যানবাহন চলাচল শুরু হয়।

গতকাল দুপুরে ইপিজেড এলাকায় গিয়ে থমথমে পরিস্থিতি দেখা গেছে। বিভিন্ন স্থানে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা অবস্থান করছিলেন।

বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে নীলফামারী সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম আর সাঈদ বলেন, ‘আমরা এখনো ঘটনাস্থলে আছি। অনুমতি ছাড়াই হাসপাতাল থেকে লাশ বাড়িতে নিয়ে গেছে পরিবারের সদস্যরা। এ ঘটনায় এখনো কোনো মামলা হয়নি। লাশ দাফনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানতে পেরেছি।’

বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য উত্তরা ইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বারের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দিয়েও তাঁকে পাওয়া যায়নি।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামান বলেন, ‘দুুপুরে আমরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর প্রতিনিধি, ইপিজেড এবং এভারগ্রিন কর্তৃপক্ষ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক ও শ্রমিক সংগঠনের  নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। শ্রমিকদের ২৩ দফা দাবির বিষয়ে পর্যালোচনা করেছি। শ্রমিকদের অভিযোগ তদন্তে বেপজা একটি কমিটি গঠন করবে। যৌক্তিক দাবিগুলো ইপিজেড বাস্তবায়ন করবে। নিহত হাবিব ইসলামের পরিবারকে আপাতত দুই লাখ টাকা দিয়েছে এভারগ্রিন কর্তৃপক্ষ, আহতদেরও ক্ষতিপূরণ দেবে।’

শ্রমিক ঐক্য সংগ্রাম পরিষদের নিন্দা : ইপিজেডের শ্রমিক নিহতের ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে জেলা শ্রমিক ঐক্য সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা, জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন ও সংঠনের সিনিয়র সহসভাপতি মাহবুব আলম টুলু। তিনি বলেন, ‘অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ইপিজেডটি আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। সেই ইপিজেডে প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে শ্রমিকদের দাবিদাওয়াকে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান না করে বল প্রয়োগ করে সমাধানের চেষ্টায় শ্রমিক হতাহতের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। হতাহতদের পরিবারের জন্য উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের দাবি জানাচ্ছি।’

বাড়ি করার সাধ পূরণ হলো না হাবিবের

অনেক স্বপ্ন নিয়ে এসএসসি পাসের পর ইপিজেডে চাকরি নিয়েছিলেন দরিদ্র পরিবারের মো. হাবিব ইসলাম। ২০২৩ সালে তিনি ইপিজেডের একটি কারখানার শ্রমিকের কাজে যোগ দেন। স্বপ্ন ছিল পরিবারের সচ্ছলতা ফেরানোর। কিন্তু
তাঁর সেই স্বপ্নসাধ আর কখনো পূরণ হবে না।

তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট হাবিব। বড় ভাই মোর্শেদ ইসলাম বিজিবি সদস্য। মেজো ভাই রাশেদুল ইসলাম ব্যবসা করেন। বড় দুই ভাই আলাদা পরিবার নিয়ে থাকায় বাবা দুলাল হোসেন (৬০) ও মা মোর্শেদা খাতুনের (৫৫) শেষ বয়সের ভরসা হয়ে ওঠেন ছোট ছেলে হাবিব। তাঁর এমন অকালমৃত্যুতে শোকাহত তার পরিবার।

গতকাল হাবিবের মৃত্যুর খবরে বাড়িতে ভিড় জমে যায় স্বজন ও প্রতিবেশীদের। এ সময় বাবা দুলাল হোসেন জানান, ছেলে চেয়েছিল একটি বাড়ি করতে। এরপর কিনতে চেয়েছিল একটি মোটরসাইকেল। বাড়ির তিনটি রুমের ইটের গাঁথুনি শেষ হয়েছে, ওপরের ছাউনির টিন কেনা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘ছেলে আর কয়দিনের মধ্যে ঘরের টিন ডাঙ্গেবার (সাঁটানো) চাইছিল। বাড়ি তৈরি হইলে একখান মোটরসাইকেল কিনিবার চাইছিল। এলা ঘরের টিন মোর পড়ি থাকিল, ওইলা ডাঙ্গাইবে কায়।’

ছেলের শোকে দিশাহারা মা মের্শেদা বেগম। তিনি বাড়ির উঠানে বিলাপ করতে করতে বলছিলেন, ‘ও বাবা, তুই আসিবি কখন, ও বাবা তুই কোথায়! তোকে ছাড়া মুই বাঁচিম কেমন করি!’

এই সম্পর্কিত আরো পোস্ট দেখতে পারেন

কমেন্ট লিখুন