চট্টগ্রাম সংবাদদাতাঃ
যথারীতি চট্টগ্রাম বন্দরের ট্যারিফ বাড়ানো হলো। ব্যবহারকারীদের বিরোধিতা সত্ত্বেও বন্দরে জাহাজ ভেড়ানো থেকে শুরু করে কনটেইনার ওঠানো ও নামানোসহ সব সেবার বিপরীতে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ট্যারিফ বেড়েছে। ৩৯ বছর পর এই ট্যারিফ বাড়ানো হলেও ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন, এতে ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। গতকাল সোমবার থেকে এ ট্যারিফ কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও সরকারের পক্ষ থেকে গেজেট প্রকাশের পর বন্দর ব্যবহারকারীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। তাদের অভিযোগ, উন্নত বন্দরের আদলে চার্জ আদায় করা হলেও, সেবার মান রয়েছে সনাতন বন্দরের মতো।
শুধু পণ্য ওঠানো বা নামানো নয়, চট্টগ্রাম বন্দরে নির্ধারিত সময়ের বেশি সময় যদি কোনো জাহাজ অবস্থান করে, তাহলে ১২ ঘণ্টার জন্য নির্ধারিত চার্জের ১০০ শতাংশ বেশি এবং পর্যায়ক্রমে ৩৬ ঘণ্টার জন্য তা ৯০০ শতাংশ পর্যন্ত পরিশোধ করতে হবে। বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গেজেট প্রকাশের আগে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যে সমন্বয় সভা হয়েছিল, সেখানে আমরা ট্যারিফ বৃদ্ধির বিরোধিতা করেছিলাম। বাড়ানোর ক্ষেত্রেও ১০ থেকে ১২ শতাংশ বৃদ্ধির সুপারিশ করেছিলাম। কিন্তু তা গ্রহণ করা হয়নি। সামগ্রিকভাবে গড়ে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়লেও ক্ষেত্রবিশেষে তা ৪০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এ বৃদ্ধির প্রভাব পড়বে দেশের আমদানি-রপ্তানিতে এবং শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের বেশি মূল্যে পণ্য কিনতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বন্দর যেহেতু ডলারে ট্যারিফ আদায় করে, তাই ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই ট্যারিফ বেড়ে গেছে। এর ওপর আবার বাড়ানো হলো।’
কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ ট্যারিফ বৃদ্ধির কারণে ভোক্তা পর্যায়ে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। এ বিষয়ে বন্দর কর্র্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘বর্ধিত ট্যারিফ দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সেবার মান বাড়ানো হবে। এতে বন্দর ব্যবহারকারীরাই লাভবান হবেন। তাই ভোক্তা পর্যায়ে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।’
তবে ভোক্তা পর্যায়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) পরিচালক রাকিবুল আলম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘বর্ধিত ট্যারিফের কারণে গার্মেন্ট পণ্যের আমদানি ও রপ্তানিতে খরচ বেড়ে যাবে। তখন পোশাক শিল্পের ক্রেতারা আমাদের দেশের পরিবর্তে অন্য দেশে কার্যাদেশ দেবেন। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে দেশের অনেক গার্মেন্ট কারখানা টিকতে না পেরে বন্ধও হয়ে যেতে পারে।’
সেবার মান না বাড়িয়ে ট্যারিফ বৃদ্ধি কেন?
মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাংসহ আশপাশের বন্দরগুলোতে সাত-আট ঘণ্টায় একটি জাহাজ থেকে পণ্য লোডিং ও আনলোডিং সম্পন্ন হয়। বিপরীতে আমাদের বন্দরে দুই-তিন দিন সময় লাগে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ। তিনি বলেন, ‘আপনি সাত-আট ঘণ্টায় না পারেন, অন্তত ২৪ ঘণ্টায় লোডিং-আনলোডিং শেষ করে জাহাজ জেটি থেকে বের করে দিন। আমরা উন্নত সেবা পেলে ট্যারিফ বৃদ্ধিতে আপত্তি নেই। কিন্তু আমরা তো তা পাচ্ছি না।’
একই মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট খায়রুল আলম সুজন। তিনি বলেন, ‘বন্দর ট্যারিফ মার্কিন ডলারে নেয়। ১৯৮৬ সালে যখন ট্যারিফ ঘোষণা করা হয়, তখন ডলারের মূল্য ছিল ৩০ টাকা। এখন ডলারের মূল্য ১২২ টাকা। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই আমরা চারগুণ বেশি দিচ্ছি। তাহলে কেন আবার ট্যারিফ বাড়াতে হবে?’
বিজিএমইএর পরিচালক রাকিবুল আলম বলেন, ‘বন্দর বারবার বলছে, ৩৯ বছর পর ট্যারিফ বাড়াচ্ছে। আমার প্রশ্ন, এত বছর কি বন্দর লোকসানে চলেছে? বন্দর যদি লোকসান না করে, তাহলে ট্যারিফ বাড়ানোর কী দরকার? চট্টগ্রাম বন্দরে গ্যান্ট্রি ক্রেন ছাড়া অন্য কোনো আধুনিক সরঞ্জাম নেই।’
এক দিনের আদেশে ট্যারিফ কার্যকর
১৪ সেপ্টেম্বর (রবিবার) গেজেট প্রকাশিত হয়েছে এবং ১৫ সেপ্টেম্বর (সোমবার) থেকে তা কার্যকরের আদেশ দেওয়া হয়েছে। এমন নজির কোনো দেশে নেই বলে উল্লেখ করেন আন্তর্জাতিক শিপিং কোম্পানি এমএসসির হেড অব অপারেশন আজমির হোসেন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমরা যে জাহাজগুলো দিয়ে পণ্য এনেছি, সেগুলো তো আগের রেটে দরদাম করা। রবিবার গেজেট প্রকাশ করে সোমবার থেকে কেন কার্যকর? এটি কার্যকর করার জন্য একটি সময়সীমা দেওয়া উচিত ছিল। এখন ডেমারেজ খরচ কে বহন করবে?’
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘এখানে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের কিছু করার নেই। সরকারের পক্ষ থেকে গেজেট আকারে আদেশ এসেছে, তাই আমরা আজ সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) থেকে তা কার্যকর করছি।’
ট্যারিফ কত বাড়ল?
চট্টগ্রাম বন্দরে আগমন-প্রস্থানকারী সব জাহাজ এবং কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সবক্ষেত্রে ট্যারিফ বেড়েছে। আগে যেখানে একটি জাহাজের পাইলটিং চার্জ ছিল ৩৫৭.৫০ ডলার, এখন তা করা হয়েছে ৮০০ ডলার। আগে ২০০ থেকে ১০০০ জিআরটির জাহাজের টাগ চার্জ ছিল ১৫৮ ডলার, এখন তা বাড়িয়ে ৬১৫ ডলার করা হয়েছে। সরঞ্জামের ক্ষেত্রে, পণ্যভর্তি ২০ ফুট কনটেইনারের গ্যান্ট্রি ক্রেন চার্জ আগে ছিল ১৫ ডলার, এখন তা ২০.৮০ ডলার। খালি ২০ ফুট কনটেইনারের ক্ষেত্রে ৭.৫০ ডলার থেকে বাড়িয়ে ১০.৪০ ডলার করা হয়েছে। ১০ টনের মোবাইল ক্রেন ব্যবহারে আগে দিতে হতো ১.৭২৩ ডলার, এখন দিতে হবে ১০.৭০ ডলার। আমদানি করা এফসিএল কনটেইনারের ক্ষেত্রে প্রথম চার দিন এবং রপ্তানিযোগ্য এফসিএল ও এলসিএল কনটেইনারের ক্ষেত্রে ছয় দিন ফ্রি টাইম রাখা হয়েছে। কিন্তু সপ্তম দিন থেকে ৬.৯০ ডলার দিয়ে ট্যারিফ আদায় শুরু হবে, যা ২১ দিন পার হলে ৬২ মার্কিন ডলার পর্যন্ত যুক্ত হবে। এ ছাড়া, বন্দরে জাহাজের অবস্থানকালে ১২ ঘণ্টা অতিরিক্ত অবস্থানের জন্য ১০০ শতাংশ, ২৪ ঘণ্টার জন্য ৩০০ শতাংশ, ৩৬ ঘণ্টার জন্য ৪০০ শতাংশ এবং ৩৬ ঘণ্টার বেশি হলে অতিরিক্ত চার্জ ৯০০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
২০ ফুট দৈর্ঘ্যরে প্রতিটি কনটেইনারে বর্তমানে গড়ে মাশুল আদায় হয় ১১ হাজার ৮৪৯ টাকা। এখন তা বেড়ে হবে ১৬ হাজার ২৪৩ টাকা। অর্থাৎ, কনটেইনারপ্রতি মাশুল গড়ে ৩৭ শতাংশ বাড়ছে। প্রতিটি কনটেইনার জাহাজ থেকে ওঠানো বা নামানোর জন্য আগে পরিশোধ করতে হতো ৪৩.৪০ ডলার, এখন তা বেড়ে ৬৮ ডলার। বাল্ক পণ্যের ক্ষেত্রে প্রতি কেজিতে আগে গড়ে মাশুল দিতে হতো ১ টাকা ২৮ পয়সা, এখন অতিরিক্ত ৪৭ পয়সা দিতে হবে।
যেভাবে ট্যারিফ অনুমোদন পেল
চট্টগ্রাম বন্দরে ট্যারিফ বাড়ানোর ক্ষেত্রে স্পেনের প্রতিষ্ঠান আইডম কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করেছে। এ সংস্থা এশিয়ার ১০টি এবং বিশ্বের ১৭টি আন্তর্জাতিক বন্দরের কার্যক্রম ও ট্যারিফ পর্যালোচনা করে চট্টগ্রাম বন্দরের ট্যারিফ নির্ধারণ করেছে। ২০২২ সালের ২৭ এপ্রিল এই ট্যারিফ নিয়ে বন্দর ব্যবহারকারীদের সঙ্গে একটি ওয়ার্কশপও অনুষ্ঠিত হয়েছিল। পরে বহু দফা সভার পর গত জুনে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষ ট্যারিফ বাড়ানোর প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। প্রস্তাবিত ট্যারিফ নৌ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর গত ২৪ জুলাই অর্থ মন্ত্রণালয় তা অনুমোদন করে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর আইন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৫ আগস্ট নৌ মন্ত্রণালয়ে বন্দর ব্যবহারকারীদের নিয়ে একটি সভা হয়। সেই সভার পর ১৪ সেপ্টেম্বর গেজেট আকারে ট্যারিফ প্রকাশিত হয়। গেজেটে বলা হয়েছে, এই ট্যারিফ ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হবে।