অন্তর্বর্তী সরকারের কেউ না কেউ প্রায় প্রতিদিনই আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলছেন। তবে ঠিক কী প্রক্রিয়ায় এ নির্বাচন হবে, সে বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ বাড়তে থাকায় ঠিক কখন নির্বাচন হবে এ বিষয়ে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দলের অনেক নেতা সন্দিহান।
রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে ভোটব্যবস্থায় কিছু মৌলিক পরিবর্তনের সূচনা আগামী নির্বাচন থেকেই করার দাবিতে সমমনা দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) যুগপৎ কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার কথা ভাবছে বলে খবর প্রচারিত হয়। তবে এনসিপি গতকাল শনিবার দলের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে বলেছে, দলটি যুগপৎ বা জোটে যাচ্ছে না।
দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক ও রাজনৈতিক লিয়াজোঁ প্রধান আরিফুল ইসলাম আদীব এতে বলেন, এনসিপি এখনো কোনো জোট বা যুগপৎ আন্দোলনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। চার দাবিতে আট দলের যুগপৎ কর্মসূচির যে খবর হয়েছে তা ‘মিসলিডিং’।
এনসিপি বলছে, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধানের যে দাবি সেটির সঙ্গে অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু পূর্ণ সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের বিষয়ে এনসিপির কোনো অবস্থান নেই। বরং এনসিপি শুধুমাত্র উচ্চকক্ষে পিআর বিষয়ে একমত।
এ ছাড়া সন্ত্রাসী ও ফ্যাসিবাদের সহযোগী হিসেবে জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিতের দাবির সঙ্গে এনসিপির সমর্থন থাকবে।
এদিকে বিএনপি মনে করে জামায়াত ও এনসিপির এই অবস্থান ‘কৌশলগত কারণে’।
এ অবস্থায় বিএনপি দেশে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রধান দলগুলোর মধ্যে ঐক্য ধরে রাখার ওপর জোর দিচ্ছে।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কৌশলগত মতভেদ থাকলেও দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য জরুরি।’ গতকাল শনিবার ঢাকায় এক আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন।
বিএনপির ভেতরকার তথ্য অনুযায়ী জাতীয় ঐক্যের বিষয়টি সামনে আনার বড় কারণ সংস্কার বাস্তবায়নের বিষয়ে জামায়াত ও এনসিপির শক্ত অবস্থান নেওয়ার পাশাপাশি ফেব্রুয়ারির ভোটের বিষয়ে দলে তৈরি হওয়া সন্দেহ। দলের একজন ভাইস চেয়ারম্যান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা ৫০ ভাগের কম।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আকস্মিক অবনতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরে এই নেতা বলেন, ফেব্রুয়ারির ভোট হতে না দেওয়ার জন্য বিভিন্ন মহল নেপথ্যে বেশ সক্রিয় আছে।
বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি নেতাদের অনেকে বলছেন, কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির জন্য আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতেও অনেকে তৎপর রয়েছে। ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বিলম্বিত হলে তারা কিছুটা সময় বেশি পেতে পারে।
ভোট ঠিক কখন হবে, সে বিষয়ে সন্দেহ থাকলেও সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে সহযোগিতা দিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত আছে বিএনপিতে। এ কারণে জুলাই জাতীয় সনদে সই করার জন্য বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও সালাহউদ্দিন আহমেদের নাম কমিশনের কাছে পাঠানো হচ্ছে। সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য কমিশন আজ রবিবার আবার দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে বসতে পারে।
অন্যদিকে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আইনি কাঠামো স্পষ্ট না হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ অনেকগুলো দল সনদে সইয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ বলেন, জুলাই সনদে সইয়ের বিষয়ে দলে আলোচনা চলছে।
এনসিপি চায়, ঐকমত্য কমিশন সুনির্দিষ্ট করে সরকারকে বলুক আইনি কী প্রক্রিয়ায় সনদটি বাস্তবায়ন করা যায়। সরকারের দায়িত্ব হবে, শুধু তা বাস্তবায়ন। এ বিষয়ে এনসিপি দলের যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, কমিশন যদি সনদ বাস্তবায়নের উপায় খোঁজার দায়িত্ব সরকারকে দেয়, তাহলে বিষয়টি অনিশ্চয়তায় পড়তে পারে। এ কারণে আইনি কাঠামোর উল্লেখ ছাড়া সনদে সই করা বা না করার বিষয়ে এনসিপি বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত নেবে।
দলগুলোর দাবির মধ্যে আছে, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে (পিআর) জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান, সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি, ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা। এনসিপির দাবির মুখে সরকার এর আগে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে। অন্যদিকে, বিএনপি চায় পিআর নয়, সরাসরি ভোটে আইনসভার সদস্যরা নির্বাচিত হবেন।
জামায়াতের ভেতরকার তথ্য অনুযায়ী, আগামী ফেব্রুয়ারিতে ভোট অনুষ্ঠানের বিষয়ে নীতিগতভাবে বিরোধিতা না করলেও চলমান জাতীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতির পুরো সুবিধা ভবিষ্যতেও পাওয়ার বিষয়টি দল নিশ্চিত করতে চায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে দলটির সমর্থক শিক্ষার্থীদের সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির ভালো ফল করেছে। একই ধারাবাহিকতায় আসন্ন রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনে এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখার বিষয়েও জামায়াত আশাবাদী। অন্য বড় সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেখানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের নজির আছে, সেখানে ভোটের দাবি শিবির তুলতে পারে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জামায়াত নেতারা মনে করছেন, ছাত্র সংসদগুলোয় জয়ের সুফল সংশ্লিষ্ট জেলায় জাতীয় নির্বাচনেও কাজে লাগানো যেতে পারে।
এনসিপি নেতারা বলছেন, পিআরসহ বিভিন্ন ইস্যুতে দলটি জামায়াত ও সমমনা দলগুলোর সঙ্গে আগে থেকেই যোগাযোগ রাখছে। ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের প্রার্থীরা প্রত্যাশিত ফল না পাওয়ায় জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল হিসেবে জামায়াতের সঙ্গে চলমান যোগাযোগ আরও বাড়তে পারে।
সরকারি সূত্র বলছে, দলগুলো সংস্কার, নির্বাচনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বিভক্ত থাকলেও নির্বাচন বিলম্বিত হলে দেশে অস্থিরতা বাড়তে পারে এমন বিবেচনা থেকে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও অধিকাংশ উপদেষ্টা আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ওপর জোর দিচ্ছেন। ইউনূসের নেতৃত্বাধীন ঐকমত্য কমিশন একই সঙ্গে ভবিষ্যতের দিকটি বিবেচনায় রেখে অর্থবহ সংস্কারের ওপরও গুরুত্ব দিচ্ছে।
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ গতকাল বলেন, সংস্কারের যে বিষয়গুলো অধ্যাদেশ ও নির্বাহী আদেশে বাস্তবায়ন করা যায়, সেগুলোর বাস্তবায়ন শুরু হচ্ছে। আর শাসনব্যবস্থা ও কাঠামোগত পরিবর্তনের জন্য মৌলিক সংস্কারের গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি নিয়ে দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে।
“সুত্র: দৈনিক দেশ রুপান্তর”