নেপালের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন দেশটির সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কি। ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে কে পি শর্মা অলি নেপালের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর পর সৃষ্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে শুক্রবার রাতে দেশটির প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পাউদেল সুশীলা কার্কিকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। শুক্রবার রাতেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান হিসেবে শপথ নেন সুশীলা। প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পাউদেল তাকে শপথ পড়ান। এ সময় নেপালের ভাইস প্রেসিডেন্ট রাম সহায় যাদব, প্রধান বিচারপতি প্রকাশ সিং রাওয়াত, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. বাবুরাম ভট্টরাই, সেনাপ্রধান জেনারেল অশোক রাজ সিগডেল, মুখ্য সচিব একনারায়ণ আরিয়াল ও কাঠমান্ডুর মেয়র বালেন্দ্র শাহ উপস্থিত ছিলেন। সুশীলা কার্কির স্বামী দুর্গ সুভেদিও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। শপথ অনুষ্ঠানে নেপালের প্রধান রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গের সমাবেশ ঘটে। শুক্রবার রাতেই মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন সুশীলা কার্কি। পরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নেপালে আগামী ৪ মার্চ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দেয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ২৬টি প্ল্যাটফর্মের ওপর সরকারের নিষেধাজ্ঞা জারি ঘিরে নেপালের চলমান সংকটের সূচনা হয়। সরকারের ওই নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে ‘জেন-জি’ অর্থাৎ তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে দেশজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হলে সরকার নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। তবে তাতে মানুষের ক্ষোভ প্রশমন হয়নি। একপর্যায়ে বিক্ষোভ রূপ নেয় সহিংসতায়। তীব্র বিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি গত মঙ্গলবার পদত্যাগ করেন। তবে তার পদত্যাগের ঘোষণা আসার আগেই ওইদিন সকালে বিক্ষোভকারীরা ভক্তপুরের বালকোট এলাকায় অলির ব্যক্তিগত বাসভবনে আগুন ধরিয়ে দেন। এ ছাড়া বিক্ষোভকারীরা নেপালের সুপ্রিম কোর্টসহ একাধিক সরকারি ভবনে আগুন ধরিয়ে দেন। পর্যটন শহর পোখারা, কাঠমান্ডুর হিলটনসহ বেশকিছু হোটেলেও হামলা-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে শুরু করলে সেনারা হেলিকপ্টারে করে মন্ত্রীদের তাদের বাসভবন থেকে সরিয়ে নিতে শুরু করেন। পরে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়, যতক্ষণ না নতুন সরকার গঠিত হচ্ছে, ততক্ষণ তারাই দেশের আইনশৃঙ্খলা ও শাসনভার সামলাবে।
এর পর থেকে দেশটিতে নতুন সরকার গঠন নিয়ে আলোচনা শুরু হয় প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পাউদেলের নেতৃত্বে। নেপালের সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রাজা রাম জানান, প্রেসিডেন্টের কার্যালয় এ প্রক্রিয়াটি দেখভাল করে।
তরুণদের বিক্ষোভ সহিংস রূপ নেওয়ার পর থেকে নেপালের প্রেসিডেন্ট পাউদেল সব পক্ষকে শান্ত থাকার এবং সহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন। তিনি বিক্ষোভকারীদের দাবিগুলো পূরণ করার আশ্বাস দিয়েছিলেন। এ ছাড়া উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নেপালি কংগ্রেস, সিপিএন-ইউএমএল এবং সিপিএনের (মাওবাদী) মতো প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নতুন যে কোনো সরকারকে সংবিধান মেনে চলার এবং সংসদ ভেঙে না দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছিল। অন্যদিকে, কাঠমান্ডুর মেয়র বালেন শাহের মতো কিছু ব্যক্তিত্ব সংসদ ভেঙে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছিলেন। এই রাজনৈতিক বিভাজন এবং অনিশ্চয়তা নেপালের সাধারণ মানুষের জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। বাস ও বিমান চলাচল ফের শুরু হলেও দোকানপাট বন্ধ রয়েছে এবং মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। নেপালি সেনাবাহিনী এবং পুলিশ আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছে, কিন্তু পুরো দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরতে আরও সময় লাগবে বলে মনে করা হচ্ছে। গতকালও নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুসহ বিভিন্ন স্থানে কারফিউ ছিল। তবে এর মধ্যেই বিক্ষোভ চলাকালে নিহত অনেকের শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়।
কে এই সুশীলা কার্কি: সাত ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে বড় সুশীলা কার্কি ১৯৫২ সালে একটি কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ভারতের বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করার পর ১৯৭৯ সালে তিনি আইন পেশায় যোগ দেন। ছাত্রজীবনে তিনি রাজনীতিতে প্রভাবশালী নেপালি কংগ্রেস পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং নব্বইয়ের দশকে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। এর জন্য তাকে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য জেলেও যেতে হয়েছিল। তার ছোট বোন জুনু দাহাল ২০১৬ সালে রয়টার্সকে বলেছিলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই তিনি সবাইকে সমান চোখে দেখতেন এবং আমাদের স্কুলে যেতে উৎসাহিত করতেন।’ ওই বছরই কার্কি প্রধান বিচারপতি হন। তিনিই দেশটির প্রথম নারী প্রধান বিচারপতি।
বিচারক হিসেবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের জন্য সুপরিচিত সুশীলা কার্কি শক্তিশালী মহলের বিরুদ্ধেও পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করেননি। এর ফলে তাকে তার মেয়াদের এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে বিচার বিভাগের শীর্ষ পদ থেকে অপসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। জনগণের চাপের মুখে সেই প্রস্তাব বাতিল হলেও হতাশ হয়ে কার্কি নিজেই পদত্যাগ করেন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জে এল ভান্ডারি রয়টার্সকে বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে অভিশংসনের প্রস্তাব আনা হয়েছিল, কিন্তু তিনি কখনোই তার নীতি থেকে সরে আসেননি। নেপালের বর্তমান সংকট সামাল দেওয়ার জন্য তিনিই সবচেয়ে সঠিক পছন্দ।’
অলি পদত্যাগ করার পর এই সপ্তাহের সহিংসতা কিছুটা প্রশমিত হয়েছে, কিন্তু কর্তৃপক্ষ কিছু এলাকায় এখনো নিষেধাজ্ঞা জারি রেখেছে। সেনাবাহিনী রাস্তায় টহল দিচ্ছে এবং বর্তমানে অজনপ্রিয় প্রধান রাজনৈতিক নেতারা আত্মগোপনে রয়েছেন।
এমন পরিস্থিতিতে সীমিত রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও কার্কিকে সাময়িকভাবে নেতৃত্বের এই ভূমিকা দেওয়া হয়েছে।
কার্কির সঙ্গে প্রায় ১০ বছর কাজ করা নেপালের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী দীপেন্দ্র ঝা রয়টার্সকে বলেন, ‘তিনি একটি ভালো পছন্দ, তবে তার একটি ভালো দল প্রয়োজন হবে।’
গতকাল নেপালের অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্রপতি তাকে নিয়োগ দেওয়ার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কার্কি দেশের উন্নয়নে কাজ করার অঙ্গীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা দেশের জন্য একটি নতুন সূচনা করতে চেষ্টা করব।’
ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কারে রাস্তায় নামল জেন-জিরা: সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞের পর এবার নেপালের জেন-জি প্রজন্ম দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে রাস্তায় নেমেছে ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করতে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওগুলোতে দেখা গেছে, তরুণ-তরুণীরা হাতে ঝাড়ু, ডাস্টবিন এবং বস্তা নিয়ে ভাঙা ইট-পাথর সরাচ্ছে, দেয়ালে রং করছে এবং লুট করা সামগ্রী ফেরত দেওয়ার উদ্যোগে অংশ নিচ্ছে। তারা শুধু আন্দোলনের প্রতীকী প্রতিবাদেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং দেশের প্রতি তাদের ভালোবাসা এবং দায়বদ্ধতা থেকে শহরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে নতুন করে গড়ে তোলার এই কাজে নেমে এসেছে। এই উদ্যোগকে তাদের নাগরিক দায়িত্ববোধ প্রদর্শনের এক গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৫১: নেপালে চলমান সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ও সহিংসতায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৫১ জনে দাঁড়িয়েছে। নেপাল পুলিশের মুখপাত্র ডিআইজি বিনোদ ঘিমিরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, নিহতদের মধ্যে ২১ জন বিক্ষোভকারী, ৯ জন কারাবন্দি, ৩ জন পুলিশ এবং ১৮ জন অন্যান্য সাধারণ নাগরিক। এ ছাড়া বিক্ষোভে আহত হয়েছেন আরও ১ হাজার ৩০০ জনের বেশি মানুষ। এর মধ্যে ২৮৪ জন এখনো দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বাকিরা চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। এই বিক্ষোভের ফলে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলার সুযোগে দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে প্রায় ১৪ হাজার কয়েদি পালিয়ে যায়। যদিও তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যককে ফের আটক করা হয়েছে, তবে আলজাজিরার রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রায় ১২ হাজার ৫০০ কয়েদি এখনো পলাতক।
এদিকে, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য নেপালি সেনাবাহিনী অভিযান শুরু করেছে। সেনাবাহিনীর সর্বশেষ আপডেটে জানা গেছে, বিভিন্ন স্থান থেকে মোট ২৬৮টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। কাঠমান্ডুর ডাল্লুতে মোতায়েন করা একটি সেনা টহল দলের কাছে এক বাসিন্দা স্বেচ্ছায় একটি ৯ মিমি চায়নিজ পিস্তল জমা দিয়েছেন। সেনাবাহিনী জনগণকে যে কোনো অননুমোদিত অস্ত্র জমা দেওয়ার জন্য সহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়েছে। দেশের অনেক রাস্তা এখনো বন্ধ রয়েছে। সড়কে সেনাসদস্যদের উপস্থিতি আগের চেয়ে কম হলেও নিরাপত্তা বাহিনী এখনো টহল দিচ্ছে।
কারফিউর মধ্যেই নিহতদের শেষকৃত্য: কাঠমান্ডুতে আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের জন্য জারি করা কারফিউ চলার মধ্যেই বিক্ষোভে নিহত অনেকে শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়েছে গতকাল। বাগমতী নদীর পাশে পশুপতিনাথ মন্দিরে গতকাল অনেক মরদেহ দাহ করা হয়। এ ছাড়া হতাহতদের পরিবারগুলো তাদের প্রিয়জনের লাশ নিতে হাসপাতাল মর্গে ভিড় করছে।
“সুত্র: দৈনিক কালবেলা”