Home » জুলাই সনদ সংবিধানের অংশ হবে

জুলাই সনদ সংবিধানের অংশ হবে

0 মন্তব্য গুলি 3 জন দেখেছে 6 মিনিট পড়েছেন

তৃণমূলের সংবাদ ডেস্ক:

জুলাই জাতীয় সনদ চূড়ান্ত করেছে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন ঐকমত্য কমিশন। অঙ্গীকারনামায় বলা হয়েছে, জনগণের অভিপ্রায়ের সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি হিসেবে গ্রহণ করায় জুলাই সনদ পূর্ণাঙ্গভাবে সংবিধানে তপশিল হিসেবে বা যথোপযুক্তভাবে সংযুক্ত করা হবে।
পূর্ণাঙ্গ খসড়ায় বলা হয়েছিল, সংবিধান ও আইনের ওপর প্রাধান্য পাবে জুলাই সনদ। আট দফা অঙ্গীকারনামায় বলা হয়েছিল, জুলাই সনদ নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। বিএনপিসহ আটটি দল এতে একমত না হয়ে জানিয়েছিল, কোনো কিছুই সংবিধানের ওপর প্রাধান্য পেতে পারে না। আদালতের প্রশ্ন তোলার সুযোগ না থাকলে নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন হবে।

বিএনপির এ অবস্থানের কারণে ঐকমত্য কমিশন চূড়ান্ত সনদে সংবিধানের ওপর প্রাধান্যের অঙ্গীকার বাদ দিয়েছে। গতকাল বুধবার জাতীয় সংসদে ঐকমত্য কমিশনের সভায় চূড়ান্ত করা সনদে বলা হয়েছে, সই করা রাজনৈতিক দলগুলো সনদ নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তুলবে না। বরং সনদ বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।

চূড়ান্ত সনদে বাস্তবায়ন পদ্ধতি রাখা হয়নি। সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি ঠিক করতে আজ বৃহস্পতিবার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ৩০ রাজনৈতিক দল এবং জোটের সঙ্গে সংলাপে বসবে কমিশন। সূত্র জানিয়েছে, বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে গণভোট, বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ, অধ্যাদেশ ও নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নের যেসব পরামর্শ পাওয়া গেছে, তা দলগুলোকে জানানো হবে। তাদের মতামত সমন্বয় করে সংবিধান সংস্কারের একটি পদ্ধতি কমিশন সরকারকে সুপারিশ করবে। কমিশন সূত্র সমকালকে এসব তথ্য জানিয়েছে।

banner

গতকাল ঐকমত্য কমিশনের সভায় চূড়ান্ত করা সনদের পটভূমিতে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন এবং ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, যা খসড়ায় ছিল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের নাম এড়াতে ছয় দফার আন্দোলনের বদলে ছেষট্টিকে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। জামায়াতের দাবি ছিল, সনদে ভাষা আন্দোলন, ২০০৬ সালের লগি-বৈঠার হত্যাকাণ্ডকে স্বীকৃতি দেওয়া। চূড়ান্ত সনদে ২০০৬ সালকে কিছু রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১৩ সালের ‘শাপলা গণহত্যা’র স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছিল ধর্মভিত্তিক দলগুলো। চূড়ান্ত সনদে একে ‘নির্মম হত্যাযজ্ঞ’ বলা হয়েছে।

বাস্তবায়নের জট এখনও খোলেনি
কমিশন সংস্কারের ৮৪ সিদ্ধান্তকে তিনটি ভাগ করেছে। ৩৪টি সংস্কার বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। ২১টি সংস্কার করা যাবে অধ্যাদেশের মাধ্যমে। ৯টি সংস্কার করা যাবে নির্বাহী আদেশ। বাকি ২০টি সংস্কার অধ্যাদেশ ও নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার বাস্তবায়ন শুরু করেছে।

যেসব সংস্কারের জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন নেই, সেগুলো অধ্যাদেশ বা নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়নে বিএনপিসহ প্রায় সব দল একমত। বিএনপি মতামতে জানিয়েছে, সংবিধান সংশোধন করতে হবে– এমন সংস্কার আগামী সংসদে গঠিত সরকার পরবর্তী দুই বছরে তা বাস্তবায়ন করবে। জামায়াতে ইসলামী এর বিরোধী। তারা নির্বাচনের আগেই সাংবিধানিক আদেশ এবং গণভোটের মাধ্যমে সাংবিধানিক সংস্কারের বাস্তবায়ন চায়। এ দলটির মতো এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদসহ কয়েকটি দল সনদের আইনি ভিত্তি এবং সনদের অধীনে নির্বাচন চায়।

দুই দফা বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা রাষ্ট্রপতির বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছেন ঐকমত্য কমিশনকে। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, গণভোটই সবচেয়ে টেকসই উপায়। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে গণভোট আয়োজন দুরূহ, সময়সাপেক্ষ এবং ভোটে তা পাস হওয়া নিয়ে সংশয় থাকায় সাংবিধানিক আদেশই নিরাপদ উপায়। যদিও বিএনপির মত হলো, সংবিধানে এমন সুযোগ নেই।

সূত্র জানিয়েছে, সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি হিসেবে আজকের সংলাপে ঐকমত্য কমিশন গণভোট, সাংবিধানিক আদেশ, অধ্যাদেশ এবং নির্বাহী আদেশ প্রস্তাব করবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। দলগুলো সাংবিধানিক সংস্কারে গণভোট বা সাংবিধানিক আদেশ– যে পদ্ধতিতে একমত হবে, সেভাবেই সনদ বাস্তবায়নে সরকারকে সুপারিশ করবে কমিশন। যদি ঐকমত্য না হয়, তবে কমিশন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ সুপারিশ আকারে সরকারকে দেবে।

কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সমকালকে বলেন, সনদ চূড়ান্ত হয়েছে। তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর। বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে কমিশন শুধু সুপারিশ করবে সরকারকে। বৃহস্পতিবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একদিনই বৈঠক হবে। সনদে আর কিছুই সংযোজন বিয়োজনের সুযোগ নেই।

চূড়ান্ত সনদ হাতে না পাওয়ায় সনদকে সংবিধানের অংশ করার অঙ্গীকারনামার বিষয়ে মন্তব্য করেননি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি জানিয়েছেন, সংলাপে অংশ নেবে বিএনপি। বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কারের বিষয়ে তিনি বলেন, আইনি এবং সাংবিধানিকভাবে বৈধ পদ্ধতিতে সংস্কার বাস্তবায়নে প্রস্তাব এলে বিএনপি আলোচনায় অংশ নেবে। দলের অবস্থান হলো, আইনের বাইরে বিএনপি যেতে পারবে না।

জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড. হামিদুর রহমান আযাদ সমকালকে বলেন, নির্বাচনের আগেই পুরো সনদের বাস্তবায়ন চাই। সংস্কারের ৮৪ সিদ্ধান্তের যেগুলোতে জামায়াতের নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি) রয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন হোক। কারণ, জামায়াত আপত্তি করলেও সেগুলোতে অধিকাংশ দলের সম্মতি রয়েছে। সাংবিধানিক সংস্কারের সিদ্ধান্তগুলো প্রথমে সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে কার্যকর করতে হবে। এরপর তা গণভোটে দিতে হবে। যদি গণভোটে সংস্কার প্রস্তাব হেরে যায়, জামায়াত জনতার রায় মেনে নেবে।
কমিশন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ এবং জুলাই ঘোষণাপত্রের ২২ ধারা অনুযায়ী সাংবিধানিক আদেশকে সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি হিসেবে সরকারকে সুপারিশ করতে পারে বলে সূত্রগুলো সমকালকে জানিয়েছে।

যা আছে চূড়ান্ত সনদ ও অঙ্গীকারে
অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত ছয়টি কমিশনের ১৬৬ সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম দফার সংলাপে ৬২টিতে ঐকমত্য হয়। দলগুলোর আপত্তিতে বাদ পড়ে ৮২টি সংস্কার প্রস্তাব। দ্বিতীয় দফার সংলাপে বাকি ২২ সুপারিশ নিয়ে আলোচনা হয়। ১১টি সুপারিশে বিএনপি, জামায়াতসহ অধিকাংশ দলের ঐকমত্য হয়। বাকিগুলোতে কমিশন তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত দেয়। এর মধ্যে ৯ সুপারিশে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পিআর পদ্ধতিতে ১০০ আসনের উচ্চকক্ষ গঠন, সংবিধান সংশোধনে উচ্চকক্ষে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিধান, নির্বাচনের আগেই উচ্চকক্ষের প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে র‍্যাঙ্ক চয়েস (পছন্দানুক্রমিক) ভোট, দুর্নীতি দমন কমিশনের নিয়োগ সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা, সরকারি কর্ম কমিশনসহ তিন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে সাংবিধানিক কমিটি গঠন। বিএনপি আগেই জানিয়েছে, যেসব সিদ্ধান্তে আপত্তি রয়েছে, ক্ষমতায় গেলে তা বাস্তবায়ন করবে না।

চূড়ান্ত সনদে সংস্কারের প্রতিটি সিদ্ধান্তে কোন ধাপে কোন দলের কী অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। খসড়া সনদে সংবিধান সংশোধনের বিধানে করণিক ত্রুটি ছিল। এক জায়গায় বলা হয়েছিল, সংবিধান উচ্চকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাগবে। আরেক জায়গায় বলা হয় সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাগবে। চূড়ান্ত সনদে এসব ভুল সংশোধন করা হয়েছে।

খসড়া সনদে আটটি অঙ্গীকার ছিল। রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতে চূড়ান্ত সনদে তা কমে সাতটি হয়েছে। সনদের ব্যাখ্যা দেবে একমাত্র সুপ্রিম কোর্ট– এ অঙ্গীকার বাদ দেওয়া হয়েছে। অঙ্গীকারের প্রথম দফায় বলা হয়েছে, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হাজারো মানুষের প্রাণে অর্জিত সুযোগ এবং জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে নতুন রাজনৈতিক ঐকমত্যের দলিল হিসেবে সনদ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে সইকারী দলগুলো।

দ্বিতীয় দফায়, জনগণ রাষ্ট্রের মালিক; তাদের অভিপ্রায়ই হবে সর্বোচ্চ আইন। তাদের অভিপ্রায় প্রতিফলিত হয় রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে। রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিতভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে জনগণের অভিপ্রায়ের সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি হিসেবে জুলাই সনদ ২০২৫ গ্রহণ করেছে। ফলে সনদ পূর্ণাঙ্গভাবে সংবিধানে তপশিল হিসেবে বা যথোপযুক্তভাবে সংযুক্ত করা হবে।

জামায়াত, এনসিপিসহ কয়েকটি দল জুলাই ঘোষণাপত্রে সংবিধানের প্রস্তাবনায় যুক্ত করার দাবি তুলেছিল। বিএনপি রাজনৈতিক দলিলকে সংবিধানে যুক্ত করার বিরুদ্ধে। দলটি সংবিধানের চতুর্থ তপশিলে জুলাই অভ্যুত্থানের উল্লেখ করে, ঘোষণাপত্রের সারাংশ যুক্ত করতে রাজি হয়েছে। জুলাই সনদকে সংবিধানে যুক্ত করার বিষয়ে দলটি এখনও অবস্থান জানায়নি।

অঙ্গীকারের তৃতীয় দফায় বলা হয়েছে, সনদের বৈধতা ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তুলবে না সই করা রাজনৈতিক দলগুলো। বরং সনদ বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করবে। পরের দফায় বলা হয়েছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সাংবিধানিক তথা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হবে। পঞ্চম দফায় গণঅভ্যুত্থানপূর্ব ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে গুম, খুন এবং অভ্যুত্থানের হত্যার বিচারের অঙ্গীকার করা হয়েছে। পরের দফায় সনদ বাস্তবায়নে সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জনের অঙ্গীকার করা হয়েছে। সপ্তম অঙ্গীকারে বলা হয়েছে, সনদে গৃহীত সংস্কারের যেসব সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য, সেগুলো কালক্ষেপণ না করেই দ্রুততম সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করবে।

এই সম্পর্কিত আরো পোস্ট দেখতে পারেন

কমেন্ট লিখুন