Home » বিচারকের চেয়ার থেকে আসামির কাঠগড়ায় তারা

বিচারকের চেয়ার থেকে আসামির কাঠগড়ায় তারা

0 মন্তব্য গুলি 4 জন দেখেছে 5 মিনিট পড়েছেন

তারা ছিলেন দেশের উচ্চ আদালতের বিচারপতি। গুরুত্বপূর্ণ সব মামলার রায় দিয়েছেন তারা। তবে বিচার বিভাগকে দলীয়করণ, পক্ষপাতিত্ব এবং রাগ-অনুরাগের বশবর্তী হয়ে রায় দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর তাদের কেউই আর বিচারকের আসনে নেই। তবে বিচারকের আসনে বসে দেওয়া রায়ের জের ধরে তারা এখন আসামির কাঠগড়ায়। কেউ কেউ ইতোমধ্যে কারাগারেও রয়েছেন।

আওয়ামী লীগ টানা ১৫ বছর ক্ষমতা ধরে রাখতে গিয়ে বিচার বিভাগকে চূড়ান্ত পর্যায়ে দলীয়করণে করে বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের থাবা থেকে রক্ষা পায়নি উচ্চ আদালতও। সেই সময় উচ্চ আদালতে বিচারপতির দায়িত্ব পালন করা কয়েকজনের বিরুদ্ধে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে মামলা হয়েছে।

নজিরবিহীনভাবে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হককে গ্রেফতারের পর কারাগারে যেতে হয়েছে। একাধিক ফৌজদারি মামলার অভিযোগ নিয়ে এক বছর ধরে কারাগারে রয়েছেন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়া সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিরুদ্ধেও রয়েছে মামলা। নতুন করে মামলার আসামি হয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর ও নিজামুল হক নাসিমকে।

banner

খায়রুল হকের বিরুদ্ধে ৪ মামলা

দেশের ১৯তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে ২০১০ সালে দায়িত্ব নেন এবিএম খায়রুল হক। বিদায়ও নেন একই বছর। স্বল্প সময়ে প্রধান বিচারপতি থাকাকালে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে ব্যাপক আলোচিত ও সমালোচিত হন। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট এবং নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংসের জন্য অনেকে তাকে দায়ী করে থাকেন।

বিচারপতি খায়রুল হক প্রধান বিচারপতির পদ থেকে বিদায় নেওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৩ সালের ২৩ জুলাই তাকে তিন বছরের জন্য আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়। একাধিকবার বাড়ানো হয় তার পদের মেয়াদ। আওয়ামী লীগের পুরোটা সময়ই তিনি এই পদে বহাল ছিলেন।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা পালানোর পর বিপাকে পড়েন খায়রুল হক। ১৩ আগস্ট পদত্যাগ করেন কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ থেকে। পরে পলাতক জীবনযাপন করেন। অবশেষে গত ২৪ জুলাই গ্রেফতার হন তিনি। দেশের ইতিহাসে তিনিই প্রথম প্রধান বিচারপতি যিনি গ্রেফতার হয়ে কারাগারে গেলেন। তার বিরুদ্ধে জুলাই গণহত্যাসহ মোট চারটি মামলা রয়েছে।

বিচারপতি খায়রুল হক এদেশের গণতন্ত্রকে হত্যা করেছেন উল্লেখ করে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম বলেন, ‘সেখানে শুধু একটি বিশেষ দলকে সুবিধা দেওয়ার জন্য তিনি আইনের অপপ্রয়োগ করে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দিয়েছিলেন। এর ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে বহু বছর সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। এর প্রধান কারিগর ছিলেন খায়রুল হক।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মাদ শিশির মনির বলেন, ‘বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী বিচারকরা যে শপথ নেন তাতে বলা আছে, কোনো রকমের অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন না। আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। কিন্তু আপনারা দেখতে পাবেন এই বিচারপতি খায়রুল হক অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে।’

সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিরুদ্ধে মামলা ও সাজা

আওয়ামী লীগ বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে (এসকে সিনহা) প্রধান বিচারপতি করলেও শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এক পর্যায়ে তাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করে আওয়ামী লীগ সরকার। পরে তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়। এর মধ্যে প্রতারণা-জালিয়াতির মাধ্যমে ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) চার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে করা মামলায় তাকে সাত বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হলে বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করেন পিরোজপুরের সুখরঞ্জন বালি, যিনি জামায়াত নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার সাক্ষী ছিলেন। মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজি না হওয়ায় গুম, অপহরণ, নির্যাতনসহ প্রায় পাঁচ বছর ভারতে অবৈধভাবে কারাবন্দী করে রাখা হয় তাকে।

বয়স অনুযায়ী ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি বিচারপতি সিনহার অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নজিরবিহীন এক পরিস্থিতির মধ্যে মেয়াদের ৮১ দিন আগেই তাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করে আওয়ামী লীগ সরকার। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের তোপের মুখে ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর ২০১৭ সালের ১১ নভেম্বর তিনি সেখানে থেকেই পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন।

বিতর্কিত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর ২০২৪ সালের ২৩ আগস্ট সিলেটের কানাইঘাটে একটি অবৈধ সীমান্ত ক্রসিং দিয়ে ভারতে পালানোর চেষ্টাকালে বিজিবির (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) হাতে আটক হন আপিল বিভাগের সাবেক বিতর্কিত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী। ২৪ আগস্ট ভোরে তাকে কানাইঘাট পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর থেকে কারাগারে বন্দী আছেন তিনি।

অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক প্রায় দুই দশক ধরে নানা কারণে দেশে বেশ আলোচিত-সমালোচিত। ২০২৪ সালের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালে একটি টিভি চ্যানেলের টকশোতে নারী উপস্থাপিকাকে ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে গালি দেন। মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল বা সংস্কার চায় সেসব শিক্ষার্থীরাও রাজাকারের বাচ্চা বলে মন্তব্য করেন তিনি।

২০০৩ সালে ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তার গাড়ি দেখেও স্যালুট না করায় আদালত অবমাননার অভিযোগ করেছিলেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সরকার হাইকোর্টে একজন পূর্ণ বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেয় চৌধুরী মানিককে। পরবর্তী সময়ে মানিকের বিরুদ্ধে নবম সংসদে নিন্দা এবং সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়। ২০১৩ সালে তার চেয়ে সিনিয়র ২১ জন বিচারককে অতিক্রম করে পদোন্নতি পান মানিক। ২০১৫ সালের অক্টোবরে প্রধান বিচারপতির নির্দেশে তাকে বেঞ্চ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া বার অ্যাসোসিয়েশন মানিকের বিরুদ্ধে রায়ে স্বাক্ষর না করাসহ ১৪ জন আইনজীবীকে কারাগারে পাঠানোর অভিযোগ করেছিল। এ ধরনের অসংখ্য বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অবসরপ্রাপ্ত এই বিচারপতির নাম।

বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির

বিচারক হিসেবে অবসরের পর এ টি এম ফজলে কবীরকে আইন কমিশনের সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। এ পদে নিয়োগ পেয়ে তিনি সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকের প্রাপ্য বেতনভাতা এবং অন্যান্য সুবিধাদি গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন।

আলোচিত মুন সিনেমা হলের মালিকানা-সংক্রান্ত সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায় সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের সঙ্গে দ্বৈত বেঞ্চে রায় দেন বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হলে তিনি ট্রাইব্যুনালের সদস্য হিসেবে নিয়োগ পান। পরে চেয়ারম্যান  হিসেবে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়।

ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান থাকাকালে তিনি জামায়াতের সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযম, নায়েবে আমির আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা তিনটির রায় দেন। সাঈদীর মামলার আসামি সুখরঞ্জন বালির মামলায় তিনিও আসামি।

বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম

বেলজিয়াম প্রবাসী এক আইন গবেষকের সঙ্গে স্কাইপ কথোপথন নিয়ে বিতর্কের মধ্যে ২০১২ সালের ১১ ডিসেম্বর বিচারপতি নিজামুল হক ট্রাইব্যুনাল থেকে পদত্যাগ করেন এবং হাইকোর্টে ফিরে আসেন। ১৯৭৯ সালে হাইকোর্ট বিভাগে এবং পরে ১৯৯৯ সালে আপিল বিভাগে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন তিনি। ২০০৯ সালের ২৫ মার্চ হাইকোর্ট বিভাগে বিচারক হিসাবে শপথ নেন বিচারপতি মো. নিজামুল হক।

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে গঠিত হয় তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত করতে পরে আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হলে তিনি প্রথম ট্রাইব্যুনালের প্রধানের দায়িত্বে থাকেন।

সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে রাজি না হওয়ায় এবং পরে সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দেওয়ায় গুম ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিযোগ করেছেন পিরোজপুরের সুখরঞ্জন বালি। সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ ৩২ জনের নামে এ অভিযোগ তুলেছেন সুখরঞ্জন বালি। সেই মামলায় বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমকেও আসামি করা হয়েছে।

“সুত্র: ঢাকা মেইল”

এই সম্পর্কিত আরো পোস্ট দেখতে পারেন

কমেন্ট লিখুন