দীর্ঘ ছয় বছর পর বহুল প্রতীক্ষিত ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ নির্বাচনকে ঘিরে ইতিমধ্যেই ঘোষণা করা হয়েছে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা। তালিকা অনুসারে কেন্দ্রীয় সংসদে ২৮টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যাচ্ছেন ৪৭১ জন এবং ১৮টি হল সংসদ নির্বাচনে ১ হাজার ৩৫ জন প্রার্থী। আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে নির্বাচনি প্রচারণা, তবে এর অনেক আগেই মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পরপরই প্রার্থীরা শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিজেদের পরিচিতি বাড়ানোর কাজে মনোনিবেশ করেছেন। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায়, আবাসিক হলসহ বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে নিজেদের পক্ষে সাড়া জাগানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। পাশাপাশি নানা সমস্যার সমাধান ও শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবিগুলো পূরণের আশ্বাসও দিচ্ছেন প্রার্থীরা। এবারের ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে আগামী ৯ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টায় ভোটগ্রহণ শুরু হবে। ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রার্থীরা প্রচার চালাতে পারবেন। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত প্রচারের সুযোগ থাকবে। এদিকে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ নির্বিঘ্ন করতে কেন্দ্র বাড়ানো ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছে ছাত্রদল। অন্যদিকে, প্রচারে আচরণবিধি লঙ্ঘন নিয়মে পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ‘বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আব্দুল কাদের। এছাড়াও গতকাল হত্যাচেষ্টা মামলায় ডাকসুর ভিপি প্রার্থী জালালকে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত।
এদিকে নির্বাচনি আমেজের ভিড়ে বেশ বিপাকে পড়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। ছাত্রসংগঠনের প্রার্থীদের তুলনায় তারা নির্বাচনি মাঠে টিকে থাকতে পারছেন না। আর্থিক সীমাবদ্ধতা, কর্মীসংকট ও প্রচারণার সীমিত সুযোগ তাদের লড়াইকে আরও কঠিন করে তুলছে। অন্যদিকে, বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের প্রার্থীরা কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনি ময়দানে নেমেছেন। জানা গেছে, ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের মনোনীত প্রার্থীদের জন্য নির্বাচনি ব্যয়ভার বহনে আর্থিক সহায়তাও দিচ্ছে। ফলে প্রচারণার দিক থেকে সংগঠনের প্রার্থীরা আরও শক্ত অবস্থানে থাকলেও, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা দিনদিন পিছিয়ে পড়ছেন।
স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা শুরু থেকেই একপ্রকার অসম প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হচ্ছেন। সংগঠনের প্রার্থীদের মতো শক্তিশালী প্রচার, আর্থিক সহায়তা কিংবা বিপুলসংখ্যক কর্মী তাদের হাতে নেই। ফলে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছাতে গিয়ে অনেক সময় নানা সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হচ্ছেন তারা।
এ বিষয়ে স্বতন্ত্র প্যানেল ‘ডিউ ফার্স্ট ’ এর ভিপি প্রার্থী জামালুদ্দীন মুহাম্মাদ খালিদ বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে যারা কোনো বলয়ের সঙ্গে পুরোপুরি সম্পৃক্ত না, বরং শুরু থেকেই নিজেরা বিভিন্ন একটিভিজম করে আসছে, তাদের জন্য নির্বাচন ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে উঠছে। একে তো যেখানে বড় ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের দলীয় জনবল নিয়ে শোডাউন দেওয়া, বিভিন্ন লজিস্টিক সাপোর্ট কিংবা হতে পারে মিডিয়া ও আর্থিক, সবদিক থেকে তারা এগিয়ে। পাশাপাশি অনেকেই বিভিন্ন আচরণবিধি লঙ্ঘন করছেন, সেক্ষেত্রে প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক আচরণ লক্ষ্য করছি। সবমিলিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের যায়গাটা সংকীর্ণ হয়ে আসছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে শুরু হয়েছে পোস্টার, ব্যনারসহ আনুষ্ঠানিক প্রচারণা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এর কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা দেওয়া হয়নি। প্রার্থীদের যাদের পরিপূর্ণ আর্থিক সাপোর্ট রয়েছে, তারা বড় বড় পোস্টার, ব্যানার লাগিয়ে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছেন। আমরা আগে থেকেই ক্যাম্পাসে যেসব কাজ করে আসছি, এখন আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্যানেলের জিএস প্রার্থী আল সাদী ভূঁইয়া বলেন, ডাকসু নির্বাচন উপলক্ষে মিডিয়াগুলো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হিসেবে কাজ করছে না। তারা প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যক্তিদের সুবিধা দেয়।
ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানো ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি ছাত্রদলের :
এদিকে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ নির্বিঘ্ন করতে কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানো, আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে পরিচালিত বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গ্রুপ বন্ধের দাবি জানিয়ে প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল।
গতকাল বুধবার বিকালে নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে ডাকসু নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে এ দাবি জানিয়েছে তারা। এ সময় ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম বলেন, ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে প্রায় ৪০ হাজার ভোটারের জন্য মাত্র আটটি কেন্দ্র রাখা হয়েছে। ভোট দিতে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর গড়ে ৮ থেকে ১০ মিনিট সময় লাগবে। সেই হিসাবে একটি কেন্দ্রে সারা দিনে সর্বোচ্চ দেড় হাজার ভোট পড়তে পারে। অথচ প্রতিটি কেন্দ্রে ৪ হাজার থেকে ৫ হাজারের বেশি ভোটার রয়েছেন। এতে করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নির্বিঘ্নে ভোট দেওয়া নিয়ে একধরনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ কারণে ভোটকেন্দ্র বাড়ানোর দাবি জানিয়েছি। তিনি বলেন, আমরা ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে দেখেছি, কীভাবে কৃত্রিম লাইন তৈরি করে অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের ভোট দিতে দেওয়া হয়নি। এবারও ভোট দিতে না পারার শঙ্কা কাজ করছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন গ্রুপ বন্ধের দাবি জানিয়ে আবিদুল ইসলাম বলেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি, ডাকসু নির্বাচনকে ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গ্রুপগুলোতে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিটিআরসিকে (বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন) চিঠি দিয়েছে। কিন্তু তারপরও এসব গ্রুপ বন্ধ হয়নি, বরং তারা নাম পরিবর্তন করে একই কাজ করছে। ঘৃণার চর্চা হচ্ছে। এসব গ্রুপগুলো যতক্ষণ পর্যন্ত বন্ধ করা না হবে, নির্বাচনের পরিবেশ শান্ত থাকবে না।
আচরণবিধি লঙ্ঘনের প্রতিযোগিতা চলছে বলে বাগছাসের অভিযোগ :
এদিকে ডাকসু নির্বাচনের প্রচারে আচরণবিধি লঙ্ঘন এখন যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের ভিপি প্রার্থী আব্দুল কাদের। গতকাল বুধবার মধুর ক্যান্টিনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন আচরণবিধি ঘোষণা করেছে ঠিকই, কিন্তু বাস্তবে কেউ তা মানছে না। কমিশন সব দেখছে, তারপরও একদলকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে সব প্যানেল প্রতিযোগিতার মতো আচরণবিধি লঙ্ঘন করছে, অথচ প্রশাসন নির্বিকার ভূমিকা পালন করছে।
হত্যাচেষ্টা মামলায় ভিপি প্রার্থী জালাল কারাগারে: এদিকে রুমমেটকে মারধরের ঘটনায় করা মামলায় ডাকসু নির্বাচনের ভিপি প্রার্থী জালাল আহমদ জালালকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছে আদালত।
গতকাল বুধবার তাকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে পুলিশ। এরপর মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শাহবাগ থানার এসআই আসাদুল ইসলাম। অপর দিকে তার আইনজীবী জামিন চেয়ে আবেদন করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মিনহাজুর রহমান তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, গতকাল ২৬ আগস্ট রাতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী রবিউল নিজের কক্ষে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। রাত সাড়ে ১২টার দিকে টেলিভিশন অ্যান্ড ফিল্ম বিভাগের শিক্ষার্থী জালাল হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলের ৪৬২ নম্বর রুমে ঢুকে বৈদ্যুতিক লাইট জ্বালান এবং চেয়ার টানাহেঁচড়া করে বিকট শব্দ করতে শুরু করেন। তাতে রবিউলের ঘুম ভেঙে যায়। তিনি জালালকে শব্দ না করার অনুরোধ করলে জালাল তাতে ক্ষিপ্ত হয়ে রবিউলের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়ায়। এক পর্যায়ে রবিউলকে মারধর করে জালাল। এ ঘটনায় গতকাল হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলের প্রাধ্যক্ষ মো. সিরাজুল ইসলাম শাহবাগ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
“সুত্র: দৈনিক ইত্তেফাক”