টাস্কফোর্সের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে ক্ষমতার দাপটে পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর শিল্পমালিকদের জব্দ ব্যাংক হিসাব খুলে দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশও নেওয়া হয়নি। অভিযোগ উঠেছে-বিপুল অঙ্কের আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে অনৈতিক কাজটি করেছেন বিএফআইইউ প্রধান এএফএম শাহীনুল ইসলাম। এই সুযোগে ওরিয়ন গ্রুপের স্বার্থসংশ্লিষ্ট রেজাউল করিম এবং এনা গ্রুপের এনায়েত উল্ল্যাহ খন্দকার তাদের ব্যাংক হিসাব থেকে শতকোটি টাকা সরিয়ে নিয়েছেন বলে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। দেশের প্রধান আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান কর্মকর্তার এমন কাজে অনুসন্ধানের উদ্যোগ নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একই সঙ্গে তার নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধের তদন্ত করছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি। খোদ বিএফআইইউ-এর তদন্ত ও দুদক সূত্রে ভয়ংকর এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এদিকে অতিসম্প্রতি শাহীনুলের বিকৃত যৌনাচারের নগ্ন ভিডিও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ইমেজ সংকটে পড়ে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থাটি। তার নৈতিক স্খলনের ঘটনা তদন্তে ২০ আগস্ট চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে অর্থ মন্ত্রণালয়। কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু শাহীনুল ইসলাম নিজেকে রক্ষায় নানাভাবে কমিটির সদস্যদের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে তার ক্ষমতার উৎস নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত সচিব মো. সাঈদ কুতুব যুগান্তরকে বলেন, ‘আমাদের তদন্তকাজ চলছে। বেঁধে দেওয়া (সাত দিন) সময়ের মধ্যেই আমরা প্রতিবেদন দাখিল করতে পারব বলে আশা করছি।’ এর বেশি কিছু বলতে অপারগতা জানান তিনি।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান যুগান্তরকে বলেন, বিএফআইইউ একটি স্বতন্ত্র আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে সংস্থাটির বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারব না।
জানা যায়, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অর্থ লোপাটকারী অলিগার্কদের কাছ থেকে পাচার করা অর্থ পুনরুদ্ধারে নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ বিষয়ে বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে কমিটিও করে দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় এ কাজে দায়িত্বপ্রাপ্তদের অন্যতম বিএফআইইউ প্রধান শাহীনুল ইসলাম যেন অর্থ লোপাটকারী দোসরদের সঙ্গে গোপন সমঝোতায় মেতেছেন। এ নিয়ে সংস্থার ভেতরে-বাইরে চরম বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। যেখানে অর্থ লোপাটকারীদের বিরুদ্ধে তার কঠোর অবস্থান নেওয়ার কথা, সেখানে তিনি ‘বুঁ আঁটুনি ফসকা গেরো’ দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ সুযোগে দোসরদের ঘনিষ্ঠ অনেক ব্যবসায়ী তাদের অবরুদ্ধ ব্যাংক হিসাব খুলে দেওয়ার জন্য শাহীনুলের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। ঘনিষ্ঠদের মাধ্যমে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। কিন্তু এ মুহূর্তে বেগতিক অবস্থার কারণে আগ্রহীদের কাছ থেকে তিনি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখছেন।
বিএফআইইউ-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাচার করা অর্থ পুনরুদ্ধারের জন্য গঠিত টাস্কফোর্সের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএফআইইউ ফ্যাসিস্টের দোসর শিল্পমালিক ও ব্যবসায়ীদের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করে। এ সময় ওরিয়ন গ্রুপের ১১টি অনিয়মের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়। এর পরই টাস্কফোর্সের নির্দেশনায় ওরিয়ন গ্রুপের মালিক ওবায়দুল করিম, তার ভাই রেজাউল করিম ও এবাদুল করিম (আওয়ামী লীগের সাবেদ সংসদ-সদস্য) এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাবগুলো অবরুদ্ধ করার নির্দেশ দেয়। ফলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সব ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের অ্যাকাউন্টও ফ্রিজ করেছিল। পরবর্তী সময়ে এএফএম শাহীনুল ইসলাম বিএফআইইউ প্রধান হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার পর রেজাউল করিম তার কাছে ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাব খুলে দেওয়ার আবেদন করেন। অবরুদ্ধ ব্যাংক হিসাব খুলে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে রেজাউল করিমের আবেদনটি পর্যালোচনা করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা, ২০১৯-এর ২৬(৬) ধারার নির্দেশ অনুযায়ী কমিটি গঠন করা হলেও কমিটির মতামত ব্যতিরেকে ২৫ মার্চ রেজাউল করিমের ব্যাংক হিসাব ‘আনফ্রিজ’ (খুলে দেওয়া) করে দেওয়া হয়। বিএফআইইউ-এর প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পাওয়ার এক মাসের মধ্যে ফ্রিজ করা অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ফলে সেসময় তার অ্যাকাউন্টে জমা ৮৪ কোটির মধ্যে ৮০ কোটি টাকাই তুলে নেওয়া হয়েছে। নাম গোপন রাখার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, তার এ পদক্ষেপ টাস্কফোর্সের কাজের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ ধরনের সিদ্ধান্ত অর্থ পাচার মোকাবিলা এবং আর্থিক ব্যবস্থার সততা পুনরুদ্ধারে সংস্থার ভূমিকাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
শাহীনুল ইসলামের এ ধরনের পদক্ষেপগুলোর মধ্যে আরেকটি হচ্ছে এনা গ্রুপের মালিক এনায়েত উল্ল্যাহ খন্দকারের ফ্রিজ করা ব্যাংক হিসাব সচল করে দেওয়া। তার ফ্রিজ করা ব্যাংক হিসাবে অন্তত ২০ কোটি টাকা ছিল। হিসাব খুলে দেওয়ার পর প্রায় সব টাকাই তুলে নেওয়া হয়েছে। এনায়েত উল্ল্যাহ খন্দকারের দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধান করছে দুদক। তার বিপুল পরিমাণ সম্পদ আদালতের নির্দেশে জব্দও করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এনা গ্রুপ চাঁদাবাজ হিসাবে স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান। তাদের জব্দ হিসাব খুলে দেওয়া কোনোভাবেই সঠিক কাজ হয়নি।
অপর একটি সূত্র বলেছে, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বিএফআইইউ প্রধানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান টিম গঠনের জন্য সব ধরনের নথিপত্র সংগ্রহ করেছে। উপর মহলের সবুজ সংকেত পাওয়া গেলেই অনুসন্ধান টিম গঠন করবে কমিশন। দুদকের ধারণা, বড় অঙ্কের অর্থের বিনিময়েই ফ্রিজ করা অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছেন তিনি। অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে সবকিছু খতিয়ে দেখা হবে।
নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধের চলমান তদন্ত, ক্ষমতার দাপটে টাস্কফোর্সের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে অবরুদ্ধ ব্যাংক হিসাব খুলে দেওয়ার বিষয়ে জানতে এএফএম শাহীনুল ইসলামের মোবাইল ফোন নম্বরে কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। একই মোবাইল ফোনের হোয়াটসঅ্যাপে সুনির্দিষ্ট বিষয় লিখে কথা বলতে চেয়ে খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি জবাব দেননি। তিনি যুগান্তরের সঙ্গে সরাসরি কথা না বললেও ভিন্ন মাধ্যমে রিপোর্ট বন্ধের তদবির করেন।
প্রসঙ্গত, সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০২৫ অনুসারে, নৈতিক স্খলন বা অসদাচরণের জন্য সরকারি কর্মচারীদের শাস্তি হিসাবে নিম্নপদে অবনমন, চাকরি থেকে বরখাস্ত অথবা চাকরি থেকে অপসারণ করা যেতে পারে। এই অধ্যাদেশটি ‘সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮’ সংশোধন করে জারি করা হয়েছে। এতে চারটি নির্দিষ্ট অপরাধের ক্ষেত্রে এই শাস্তির বিধান রয়েছে। তদন্তে শাহীনুল ইসলামের বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলনের বিষয়টি প্রমাণ হলে আইন অনুযায়ী যে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে বলে জানা গেছে।
“সুত্র: দৈনিক যুগান্তর”