Home » মাইলস্টোনে যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনা বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন ২৩ আহতের পরিবার আর্থিক সংকটে

মাইলস্টোনে যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনা বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন ২৩ আহতের পরিবার আর্থিক সংকটে

এগারো বছর বয়সী মুনতাহা তোহা কর্ণ। রাজধানীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সে। গত ২১ জুলাই যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনায় শরীরের ১৫ শতাংশ পুড়ে যায় তার।

0 মন্তব্য গুলি 4 জন দেখেছে 4 মিনিট পড়েছেন

এগারো বছর বয়সী মুনতাহা তোহা কর্ণ। রাজধানীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সে। গত ২১ জুলাই যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনায় শরীরের ১৫ শতাংশ পুড়ে যায় তার। সেই থেকে গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন সে। তার সঙ্গে কাজকর্ম ছেড়ে গোটা পরিবারকেও থাকতে হচ্ছে সেখানেই। এ সময়ের মধ্যে এখন পর্যন্ত প্রায় ৭০-৮০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে পরিবারটির, যার মধ্যে বেশকিছু অর্থ ধারও করতে হয়েছে। উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে উল্টো খরচ বেড়ে যাওয়ায় আর্থিক সংকটে ভুগছে পরিবারটি।

গতকাল দুপুরে হাসপাতালটির ১৪০৭ নম্বর কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, মুনতাহার মা তাকে খাওয়াচ্ছেন। বাবা নিচে থেকে ওষুধ ও সবার জন্য খাবার নিয়ে এলেন। চার-পাঁচ বছর বয়সী ছোট ভাইটিকে কাছে রাখছেন দাদি। এভাবে এক মাসে ধরে সব ধরনের কাজ ছেড়ে হাসপাতালে অবস্থান করছেন তারা। এ সময় মুনতাহার মা রুকাইয়া আখতার পুষ্প এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘যেভাবে বাচ্চাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাতে ওদের সুস্থ হতে অনেক সময় লাগবে। টাকাও লাগবে। অনেককে রিলিজ দিয়েছে। আমাদেরও হয়তো অচিরেই দিয়ে দেবে। এরপর চিকিৎসার জন্য আমরা অর্থ পাব কোথায়? ছোট একটা ব্যবসা আছে আমাদের। সেটা গুটিয়ে সপরিবার এখানে থাকতে হচ্ছে। উপার্জনের পথ সব বন্ধ। এই এক মাসে ৬০-৭০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। চিকিৎসার ব্যয় বহন করলেও আর কোনোভাবে সহযোগিতা করেনি কেউ। বাসায় গেলেও আরো চিকিৎসা প্রয়োজন হবে। এ অর্থ কোথায় পাব?’

শুধু মুনতাহার পরিবার নয়, বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানটিতে ভর্তি থাকা ২৩ আহত শিশুর পরিবারের অবস্থা একই। চার-পাঁচজন আহতের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে স্বজনেরা জানান, তাদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবার। বাকি প্রায় সবাই মধ্যবিত্ত। কাজ করলে চলা যায়, কাজ না থাকলে ঋণের চাপে পড়তে হয়। দীর্ঘ এক মাস ধরে পরিবারের তিন-চারজন সদস্যকে পালা করে হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে। আহতসহ তাদের খাবার ও যাতায়াতসহ আনুষঙ্গিক খরচ মিলিয়ে দৈনিক দেড়-দুই হাজার টাকা খরচ করতে হয়। এছাড়া রোগীর ফলমূল ও ওষুধপত্র মিলে আরো অন্তত ১ হাজার টাকা লাগে। সব মিলিয়ে একজন রোগীর পেছনে এক মাসে অন্তত ৭০-৮০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। কোনো কোনো পরিবারের এক-দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়েছে, যা মধ্যবিত্ত একটি পরিবারের পক্ষে বহন করা দুঃসাধ্যের।

অন্য পরিবারগুলোও আর্থিক সংকটে ভুগছে উল্লেখ করে মুনতাহার মা পুষ্প বলেন, ‘আমরা সবাই প্রতিনিয়ত একে অন্যের সঙ্গে কথা বলছি। প্রায় সবাই আর্থিক সংকটে আছেন। গরিবরা হাত পেতে নিতে পারে আর ধনীদের সাহায্যের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু আমাদের প্রায় সবাই মধ্যবিত্ত পরিবারের। আমরা মুখ ফুটে কেউই সংকটের কথা বলতে পারি না।’

কথা বলতে বলতে তিনি পাশের ১৪৬৬ নম্বর কক্ষে নিয়ে যান। সেখানে পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে আছে মাইলস্টোন স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর দুই ছাত্রী রুপি বড়ুয়া রয়া ও আসিফা জান্নাত রাইসা। তাদের শরীরের যথাক্রমে ১২ ও ২০ শতাংশ পুড়ে গেছে। রাইসার সঙ্গে সার্বক্ষণিক স্কুলশিক্ষক বাবা ও মাকে থাকতে হচ্ছে। অন্যদিকে রয়ার সঙ্গে রয়েছেন তার বাবা, মা ও বোন।

রয়ার বাবার একটি দোকান রয়েছে। সেই দোকানের আয়েই চলে তাদের সংসার ও তিন বোনের লেখাপড়া। রয়ার বড় বোন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাবা-মা আর আমি দুর্ঘটনার পর থেকে হাসপাতালে। দুর্ঘটনার সময় আমার মেজো বোনের পরীক্ষা চলছিল। সে পরীক্ষার পাশাপাশি আমাদের জন্য খাবার তৈরি করত। উত্তরা থেকে প্রতিদিন যাতায়াতে আমাদের অন্তত ১ হাজার ৬০০ টাকা সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া লাগে। সবাই বলছেন মাইলস্টোনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর অনেক টাকা। কিন্তু এখন তো উপার্জনের কোনো পথ নেই। সব কাজ বাদ দিয়ে হাসপাতালে পড়ে থাকলে সচ্ছলতা থাকে?’

সরকারের দায়িত্বের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমরা কেন সরকারের দ্বারে দ্বারে ঘুরব? সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের উচিত আমাদের খোঁজ নেয়া। এ দুর্ঘটনার জন্য কি রাষ্ট্রের দায়ভার নেই? আমার বোনকে নিয়ে এক মাস ধরে এখানে আছি সরকার চিকিৎসাসেবা বাদে আমাদের জন্য আর কিছুই করেনি। এতগুলো বাচ্চার সুস্থ জীবন নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না?’

ক্ষত শুকানোর আগেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আগামী রোববার রিলিজ দেয়ার অভিযোগ তোলেন রাইসার মা। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ের ক্ষত এখনো ভালোভাবে শুকায়নি। তার পরও রিলিজ দিতে চাচ্ছে। ওর আরো চিকিৎসা দরকার। আবারো চামড়া ফুলে গেছে। দু-একদিন থাকার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানালে বাজে ব্যবহার করেছে। আমরা তো আত্মসম্মানের জন্য কিছু বলতে পারি না।’

তিনি আরো বলেন, ‘ক্ষত শুকানোর পর হাত-মুখ-পাসহ প্রতিটি অঙ্গে আলাদা থেরাপি দিতে হবে। এতে প্রায় এক-দেড় হাজার টাকা লাগবে। এজন্য প্রতিদিন সিআরপিতে যাতায়াত করতে হবে। যেহেতু পোড়া রোগী হিসেবে রোদে কিংবা এসি ছাড়া চলা যাবে না, সেহেতু পাবলিক ট্রান্সপোর্ট এড়িয়ে প্রাইভেট কারে আনা-নেয়া করতে হবে। ফলে প্রতিদিন মোটা অংকের পরিবহন খরচ বহন করতে হবে। বাসায় এসি লাগবে কিন্তু আমাদের সবার বাসায় কি এসির ব্যবস্থা আছে? এছাড়া বাচ্চার লেজার ট্রিটমেন্ট করাতে হবে। সার্জারি করাতে হবে। রিলিজ দিলেই তো সরকারের দায়িত্ব শেষ। এরপর এ খরচগুলো কীভাবে বহন করব?’

দুর্ঘটনার পর থেকে রাইসার স্কুলশিক্ষক বাবা কাজে যেতে পারছেন না; সন্তানের সঙ্গে হাসপাতালে পড়ে আছেন। এতে উপার্জন বন্ধ কিন্তু খরচ বেড়ে যাওয়ার কথা তুলে ধরে বলেন, ‘রাইসাকে দেশী মুরগি খাওয়াতে ও রোদে না নিতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। পাবলিক পরিবহন এড়িয়ে চলতে বলা হয়েছে। সানস্ক্রিন, বিশেষ ধরনের কোকোনাট অয়েল ব্যবহারসহ বিভিন্ন ধরনের ওষুধপত্র সেবনের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এসবের জন্য প্রতিদিন অন্তত ২ হাজার টাকা করে খরচ করতে হবে। এ ব্যয়ভার বহন করার সক্ষমতা আমাদেরসহ অধিকাংশ পরিবারেরই নেই।’

রোগীদের রিলিজ দেয়ার ক্ষেত্রে বোর্ড মিটিংয়ের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের কন্ট্রোল রুমের একজন চিকিৎসক। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘ছাড়পত্র পাওয়ার পর রোগীদের অবশ্যই থেরাপি নিতে হয়। আর এর চার্জ প্রতিষ্ঠানভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। সানস্ক্রিন ও কোকোনাট অয়েলের দাম মান অনুযায়ী ভিন্ন হয়। সাত-আটশ থেকে শুরু করে হাজার টাকা। রোদে না যাওয়ার নির্দেশনা সব রোগীর জন্যই থাকে।’

আর্থিক সংকটে পড়া পরিবারগুলোর জন্য সরকারের কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম, তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরারের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের সাড়া পাওয়া যায়নি।

সূত্রঃ বণিক বার্তা

এই সম্পর্কিত আরো পোস্ট দেখতে পারেন

কমেন্ট লিখুন