বিগত তিন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক বিবেচনায় যেসব ভোটকেন্দ্র হয়েছে সেগুলো বাদ দিতে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তাদের বলা হয়েছে, আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা বাড়লেও ভোটকেন্দ্র বাড়বে না। প্রতিটি ভোটকক্ষে ১০০ জন ভোটার বাড়িয়ে নতুন ভোটার সমন্বয় করতে হবে। সোমবার ‘মাসিক সমন্বয় সভা’য় নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের এসব নির্দেশনা দেন। ওই সভায় জানানো হয়, এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র স্থাপন এবং ব্যবস্থাপনা নীতিমালা’য় আবারও সংশোধনী আনা হবে। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী ভোটকেন্দ্র ও ভোটকক্ষ নির্ধারণ করতে হবে। বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক কর্মকর্তা যুগান্তরকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় ইসি সচিবালয়, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ ও নির্বাচনি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা এবং জেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা অংশ নেন। বৈঠকে আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বক্তব্য রাখেন।
ইসির কর্মকর্তারা জানান, নতুন ভোটার সংখ্যা বিবেচনায় সারা দেশে মোট ভোটকেন্দ্র ৪৫ হাজারের বেশি হওয়ার কথা। একই সঙ্গে ভোটকক্ষ বেড়ে প্রায় দুই লাখ ৭৮ হাজার হওয়ার কথা। ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র ৪২ হাজার ১৪৮টি ও ভোটকক্ষ দুই লাখ ৬১ হাজার ৫৬৪টি ছিল। ওই সময়ে ভোটার সংখ্যা ছিল ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৮৯ হাজার ২৮৯ জন। এবার তিন ধাপে ভোটার তালিকা হালনাগাদের পর ভোটার সংখ্যা দাঁড়াবে পৌনে ১৩ কোটি। ইসির নতুন এ নির্দেশনার ফলে আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র ও ভোটকক্ষের সংখ্যা খুব একটা বাড়বে না। প্রসঙ্গত, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের তফশিল আগামী ডিসেম্বরে এবং ভোটগ্রহণ ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
বৈঠকে দেওয়া নির্দেশনার বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, দুটি বিষয় বিবেচনায় রেখে ভোটকেন্দ্র না বাড়ানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রথমত, ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তাজনিত বিষয় এবং দ্বিতীয়ত, নির্বাচনি ব্যয় কমানো। ভোটকেন্দ্র ও ভোটকক্ষ না বাড়লে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন ও তাদের পেছনে যে ব্যয় হতো সেটা আর হবে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভোটার সংখ্যা বাড়লেও ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা না বাড়ার কারণে ভোটারদের ভোগান্তি বা ভোটগ্রহণে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে। বরং সময়ের পূর্ণ ব্যবহার হবে।
এদিকে ইসিতে এক ব্রিফিংয়ে ইসি সচিব বলেন, মাসিক সমন্বয় সভায় আমরা বলেছি যে, ভোটকেন্দ্র সংখ্যা বাড়বে না। বাড়বে না এর অর্থ এই নয় যে, অতীতে যা ছিল সেটাই একদম হুবহু রাখতে হবে। যৌক্তিক বিবেচনায় যদি বাড়ানোর প্রয়োজন হয়, সেটা বাড়বে।
আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত ২৬ জুন ভোটকেন্দ্র স্থাপনা ও ব্যবস্থাপনা নীতিমালা জারি করে কমিশন। ওই নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতি তিন হাজার ভোটারের জন্য একটি ভোটকেন্দ্র হবে। প্রতি ৫০০ জন পুরুষের জন্য একটি ভোটকক্ষ এবং প্রতি ৪০০ জন নারীর জন্য একটি ভোটকক্ষ নির্ধারণ করতে হবে। বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, সমন্বয় সভায় প্রতি ৬০০ জন পুরুষের জন্য একটি এবং প্রতি ৫০০ জন নারীর জন্য একটি ভোটকক্ষ নির্ধারণ করতে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাদের বলা হয়েছে, বিদ্যমান নীতিমালায় এসংক্রান্ত সংশোধনী আনা হবে। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের চিঠিও দেওয়া হবে।
ভোটকেন্দ্র বৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরার যৌক্তিকতা তুলে ধরে ইসির ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে একজন প্রিজাইডিং, ভোটকক্ষের সমান সংখ্যক সহকারী প্রিজাইডিং এবং দুজন করে পোলিং কর্মকর্তা থাকেন। অর্থাৎ ছয় ভোটকক্ষ সম্বলিত একটি কেন্দ্রে একজন প্রিজাইডিং, ছয়জন সহকারী প্রিজাইডিং এবং ১২ জন পোলিং কর্মকর্তা মিলিয়ে ১৯ জন ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা এবং ১৪-১৫ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন থাকেন। অর্থাৎ একটি কেন্দ্রে ৩৫ জন জনবলের প্রয়োজন হয়। বাড়তি কেন্দ্রের লাগাম টানতে পারলে নির্বাচনে জনবলের সংখ্যা কমে যাবে। এসব কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যেসব সদস্যকে মোতায়েন করা হতো, তাদের অন্যান্য কেন্দ্র ও নির্বাচনি এলাকায় মোতায়েন করা সম্ভব হতো। এছাড়া ভোটকেন্দ্র স্থাপনের জন্য পৃথক খরচ হয়। ভোটকেন্দ্র বৃদ্ধির লাগাম টানা হলে নির্বাচনে অন্তত ১০০ কোটি টাকা বাড়তি ব্যয় থেকে রেহাই পাবে কমিশন মনে করছে।
ওই কর্মকর্তারা আরও জানান, সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন ভোটকেন্দ্র স্থাপন এবং ব্যবস্থাপনা নীতিমালা’য় বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছিল। তখন উপজেলা পর্যায়ে ইউএনও ও ওসি এবং জেলা পর্যায়ে ডিসি ও এসপিদের ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ কাজে যুক্ত করা হয়। ওই সময়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেক কেন্দ্র নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া ২০১৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তৎকালীন প্রভাবশালীরা নিজেদের আওতাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অবকাঠামোতে ভোটকেন্দ্র করেছিল। ইসির নতুন এ নির্দেশনার ফলে ওইসব কেন্দ্র বাদ দেওয়া কর্মকর্তাদের জন্য আবশ্যক হয়ে দাঁড়াল। যদিও নীতিমালায় রাজনৈতিক প্রভাবাধীন প্রতিষ্ঠানে কেন্দ্র না করার বিধান রয়েছে।
ভোটকেন্দ্র না বাড়ানোর সিদ্ধান্তের কারণে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তারা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন আরও কয়েকজন কর্মকর্তা । তারা বলেন, সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ হয়। আট ঘন্টা অর্থাৎ ৪৮০ মিনিটের এ সময়ে ৬০০ জন ভোট দেওয়া এক প্রকার অসম্ভব। যদিও সংসদ নির্বাচনে শতভাগ ভোট পড়ে না। নির্বাচনে যদি ৮০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি হয়, তখন একটি কক্ষে ভোটার উপস্থিতি হবে ৪৮০ জন। তখন প্রতি মিনিটে একজনের ভোট সম্পন্ন করার দরকার হবে। এক্ষেত্রে ভোটকক্ষের সামনে দীর্ঘ লাইন তৈরি হবে। নির্ধারিত সময়ের পরও ভোটগ্রহণ করতে হবে।
বৈঠক সূত্র আরও জানায়, সমন্বয় সভায় ভোটকেন্দ্র স্থাপন নীতিমালার এজেন্ডার ওপর আলোচনার এক পর্যায়ে এক কর্মকর্তা বিগত নির্বাচনগুলোতে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেক ভোটকেন্দ্র স্থাপনের বিষয় উত্থাপন করেন। জবাবে ইসির সিনিয়র সচিব বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় যেসব ভোটকেন্দ্র হয়েছে, নীতিমালা অনুযায়ী সেগুলো বাদ দিতে হবে। আশপাশের যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করতে হবে। ইসির একাধিক আঞ্চলিক ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ভোটকেন্দ্র নির্ধারণে অনানুষ্ঠানিভাবে কাজ করছেন উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা। তারা প্রাথমিক তালিকা তৈরি করছেন। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের টয়লেট, বিদ্যুৎ সংযোগ, নিরাপত্তা দেওয়ালসহ অন্যান্য সুবিধাদি রয়েছে, সেগুলোর তালিকা তৈরি করছেন। নতুন নীতিমালা জারি এবং ইসি থেকে চিঠি পাওয়ার পর আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু করবেন। এছাড়া বৈঠকে নির্বাচনি উপকরণ নিরাপদে সংরক্ষণ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। নির্বাচনি উপকরণ রাখার জন্য মাঠপর্যায়ের গুদামে জায়গা ফাঁকা রাখার পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। এছাড়া স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স কোথায় কী অবস্থায় আছে তা নিয়ে আলোচনা হয়। মাঠ কর্মকর্তারা জানান, ঢাকা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের জেলাগুলোতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যালট বাক্স আছে। বাকি অঞ্চলগুলোতে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের সংকট আছে। সভায় মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যালট বাক্স আন্তঃসমন্বয় করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
“সুত্র: দৈনিক যুগান্তর”