Home » স্বৈরাচারের পথ বন্ধ করতে হবে

স্বৈরাচারের পথ বন্ধ করতে হবে

ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা

0 মন্তব্য গুলি 2 জন দেখেছে 5 মিনিট পড়েছেন

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, রাষ্ট্র সংস্কারের মধ্যে স্বৈরাচার ফিরে আসার সব পথ বন্ধ করতে হবে। আর এই সংস্কার হতে হবে রাজনৈতিক ঐকমত্য ও সমঝোতার মাধ্যমে। ঐকমত্যের ইস্যুগুলোর ফয়সালা করে ফেলতে পারলে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সত্যিকার অর্থে জাতির নবজন্ম হবে। এ নির্বাচন হবে মহোৎসবের।

রোববার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে তিনি এসব কথা বলেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হলে শুধু নিরাপত্তা নয়, আঞ্চলিক নিরাপত্তায় সমস্যা হবে। কারণ ভূরাজনৈতিক নানা সমস্যা রয়েছে। ফলে দেশকে আমরা এই ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে পারি না। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, আগামী নির্বাচন জুলাই সনদের ভিত্তিতে হলেই তা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হবে। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জামায়াত নেতা বলেন, মুক্তিযুদ্ধ না মানলে বাংলাদেশকে তো অস্বীকার করা হয়ে যাবে। বাংলাদেশের আইনি প্রক্রিয়া ও সাংবিধানিক পদ্ধতি মেনেই রাজনীতি করে আসছি।

এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, মৌলিক সংস্কার হতে পারে শুধু গণপরিষদ ভোটে। সংস্কার অসমাপ্ত রেখে ফ্যাসিবাদী কাঠামোর দিকে যেতে পারি না। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের রোববারের আলোচনায় মূল বিষয় ছিল জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন। কিন্তু এদিন কোনো ঐকমত্যে আসতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো।

ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে বৈঠকে জানানো হয়, জুলাই সনদ রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল। এই সনদ শুধু রাজনৈতিক সংস্কারের রূপরেখাই নয়, এটি দেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদি রোডম্যাপ। যা দেশের গণতন্ত্র ও সুশাসনের ভিত্তি শক্তিশালী করবে। তবে কার্যকর করতে হলে প্রয়োজন সর্বাত্মক রাজনৈতিক ঐকমত্য। অনুষ্ঠানে সরকারের চারজন উপদেষ্টা উপস্থিত ছিলেন। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এ সময়ে জানান, সব সংস্কার নভেম্বরের মধ্যে শেষ করতে হবে। কারণ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর কোনো মৌলিক কাজ করা যায় না।

banner

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ঐকমত্য কমিশন গঠনের সময় তিনি নিশ্চিত ছিলেন না এ উদ্যোগ সফল হবে কিনা। কিন্তু দীর্ঘ আলোচনা ও ধৈর্যের মধ্য দিয়ে কমিশনের সদস্যরা একটি ‘অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত’ স্থাপন করেছেন। মূল কাজ হয়ে গেছে। বাকি কাজ সুন্দরভাবে শেষ করলে পৃথিবীর জন্য নজির সৃষ্টি হবে।

রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশে তিনি বলেন, সমঝোতার পথ ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। যত যুক্তি দেই সমঝোতাই সমাধান। যখন নির্বাচনে যাব তখন একমত হয়ে সবাই যাব। এর মধ্যে কোনো দ্বিমত আমরা রাখব না। এত ত্যাগ সার্থক তখনই হবে, যদি নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা নবজন্ম লাভ করতে পারি।

সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, নির্বাচনের সঙ্গে অন্য কিছুর সম্পর্ক নেই। কারণ সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া। এটি চলতে থাকবে। বিচারের কথা বলা হচ্ছে। দ্রুত বিচার করলে সে বিচার প্রশ্নবিদ্ধ হবে। তাই নির্বাচনের সঙ্গে অন্য কিছু মেলানো ঠিক হবে না। ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠান যেন না হতে পারে, যেন একটি অনিশ্চিত পরিবেশ সৃষ্টি হয়, ফ্যাসিবাদী শক্তি সেই চেষ্টা করছে। প্রতিবেশী শক্তিধর দেশগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘এখানে দুটি রিজিওনাল শক্তি। আমরা বাংলাদেশকে সেখানে নিতে চাই না। নির্ধারিত টাইম লাইনে নির্বাচন হতেই হবে।’ সংবিধান সংস্কারের কথা তুলে ধরে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, এখানে ১৯টি মৌলিক বিষয় চিহ্নিত করা হয়েছে। বাস্তবে মৌলিক বিষয় আরও অনেক আছে। আমরা ৮২৬টি ছোট-বড় সংস্কার প্রস্তাব পেয়েছি। মৌলিক সংস্কার মিলে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৪৫টি। এগুলো দলে আলোচনা করে লিখিত মতামত দিয়েছি। মাত্র ৫১টি প্রস্তাবে আমরা দ্বিমত করেছি, ১১৫টি প্রস্তাবে আমাদের মতামতসহ ভিন্নমত দিয়ে গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছি। এ বিষয়ে চূড়ান্ত ঐকমত্য হয়েছে প্রায়। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা বলেছি, আইনি ভিত্তি নিয়ে আলোচনা হলে আমরা তাতে অংশ নেব। সেই আলোচনা শুরু হয়েছে। তার আগে কমিশন বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েছে। সেখান থেকে অঙ্গীকারনামার যে ড্রাফট দেওয়া হয়েছে, তাতে আমরা লিখিত মতামত দিয়েছি। যেসব বিষয় পরে টিকবে না, সেগুলো এতে উত্থাপন করা ঠিক হবে না। সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, সনদ বাস্তবায়নে যে প্রস্তাব এসেছে, এর বাইরেও অনেক পন্থা থাকতে পারে। আপিল বিভাগের পরামর্শ নিতে পারি আমরা। একটি এক্সট্রা কনস্টিটিউশনাল অর্ডার বা স্পেশাল কনস্টিটিউশনাল অর্ডার করা যায় কিনা। তাহলে ভবিষ্যতে জুডিশিয়ারিতে এটি চ্যালেঞ্জ করলেও বলতে পারবে আমরা মতামত নিয়েছিলাম। প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশে বিএনপির এ নেতা বলেন, বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ আপনি করলেন। আমরা কেউ কিছু বললাম না। ঐকমত্য কমিশন থেকে আমরা আপনাকে দায়িত্ব দিলাম। সনদ বাস্তবায়নের ব্যাপারে আপনি সিদ্ধান্ত দেন। তারপর আপনি করলেন। কিন্তু যে কোনো একজন নাগরিক যদি এটি নিয়ে চ্যালেঞ্জ করেন, সেটি আপনার বৈশ্বিক ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলবে।

জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে দুটি উপায় আছে। এর মধ্যে রয়েছে বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ এবং গণভোট। অতীতে বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের নজির আছে। এটার ইতিহাসও দেশে আছে। আর এ ইস্যুতে দলগুলো একমত হতে না পারলে গণভোটের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে। তিনি আরও বলেন, সরকারের তিনটি প্রতিশ্রুতি ছিল। এর মধ্যে প্রথম ছিল সংস্কার করা। বিগত দিনে রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে যে ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতিতে ধ্বংস আবর্জনা তৈরি হয়েছিল, এটা দূর করে বাংলাদেশকে একটি নতুন পথে নিয়ে যাবে। দ্বিতীয় প্রতিশ্রুতি ছিল গণহত্যার বিচার এবং তৃতীয় ছিল উৎসবমুখর পরিবেশে ইতিহাসের নির্বাচন। প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুযায়ী আগামী নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হবে। নির্বাচন নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের দুটি নির্বাচন কিছুটা আমাদের উদ্বিগ্ন করেছে। এই উদ্বেগ ছিল নির্বাচনের পরিবেশ এবং নির্বাচনের ফল ঘোষণা নিয়ে। নির্বাচনকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে যতটুকু আমরা লক্ষ্য করেছি, এটাকে আমরা একটি নেতিবাচক সংকেত হিসাবে দেখতে চাই। এটার প্রভাব জাতীয় নির্বাচনে পড়বে কিনা, সেই জায়গা থেকে আমরা উদ্বেগের কথা জানাচ্ছি। যেন আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ একটি প্রশাসনব্যবস্থার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বারবার বলেছি বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ আমাদের অর্জন। বাংলাদেশকে মেনে নিয়েই কিন্তু সবাই রাজনীতি করছে। আমরাও তা-ই। অন্যদিকে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে এই জামায়াত নেতা প্রস্তাব করেন জুলাই সনদ না মানলে আগামী নির্বাচনে প্রার্থিতা বাতিলের বিধান চালু করতে হবে।

আখতার হোসেন বলেন, ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশ টেকসই করতে হবে। এই টেকসই বাস্তবায়নে সব দলের সহযোগিতা জরুরি। তিনি বলেন, সংবিধান সম্পর্কিত বিষয় অনিশ্চয়তার মধ্যে রাখলে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। এতদিনের আলোচনা আইনি ভিত্তি দিতে হবে। সনদের নাম জুলাই সনদই হতে হবে, জাতীয় সনদ নয়। তার মতে, ৮৪টি বিষয়ের মধ্যেই ৪৩টি সংবিধানের সঙ্গে সম্পর্কিত। এ বিষয়ে সমাধান করতে হবে। অর্ধশতক পরে পাওয়া এ সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।

ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি ড. আলী রীয়াজ বলেন, অতীতে দলগুলোর মধ্যে যে সহযোগিতার ধারা তৈরি হয়েছিল, সামনের মাসগুলোতে তা অক্ষুণ্ন রেখে চূড়ান্ত পরিণতিতে পৌঁছাতে পারব। এটি কমিশনের প্রত্যাশা। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য অপরিহার্য। পরাজিত ফ্যাসিবাদী শক্তি এখনো চায়, এ প্রক্রিয়া যেন সফল না হয়। কিন্তু যে রক্তের ওপর দিয়ে আমরা এখানে এসেছি, তার প্রতি আমাদের দায় হচ্ছে, এই প্রক্রিয়াকে সফল করা।

“সুত্র: দৈনিক যুগান্তর”

এই সম্পর্কিত আরো পোস্ট দেখতে পারেন

কমেন্ট লিখুন