Home » সাঈদের লাশের সুরতহালে ‘ছররা গুলি’ লিখলে আওয়ামী লীগের লোক দিয়ে মেরে ফেলব

সাঈদের লাশের সুরতহালে ‘ছররা গুলি’ লিখলে আওয়ামী লীগের লোক দিয়ে মেরে ফেলব

রংপুর পুলিশের এসি বললেন

0 মন্তব্য গুলি 3 জন দেখেছে 3 মিনিট পড়েছেন

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শহীদ আবু সাঈদ হত্যা মামলায় সাক্ষীর জবানবন্দি দিয়েছেন পুলিশের উপ-পরিদর্শক মো. তরিকুল ইসলাম।

মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ তিনি জবানবন্দি প্রদান করেন।

মো. তরিকুল ইসলাম তার জবানবন্দিতে বলেন, আমি বর্তমানে ডিএমপি, ঢাকার ভাষাণটেক থানা, মিরপুর বিভাগে কর্মরত আছি। ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই রংপুর মেট্রোপলিটন কোতোয়ালি থানা এলাকা এবং হাসপাতালে ইউডি (অপমৃত্যু) ডিউটিতে নিয়োজিত ছিলাম। সেই দিন রংপুরে বৈষম্যবিরোধী ও কোটা আন্দোলন চলমান ছিল। বিকাল আনুমানিক ৪টা ৩০ মিনিটের দিকে রংপুর মেট্রোপলিটন তাজহাট থানার বেতার বার্তার মাধ্যমে জানতে পারি— রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে একটি লাশ আছে, তার সুরতহাল করতে হবে।

‘আমার সঙ্গীয় কনস্টেবল লিটন দেবনাথসহ রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে উপস্থিত হই এবং জানতে পারি যে, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে একজন ছাত্র পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে, তার নাম আবু সাঈদ। তখন মেডিক্যাল কলেজের ভেতরে অনেক উত্তেজনা বিরাজ করছিল, সেখানে অনেক পুলিশ ডিউটিরত ছিল। সন্ধ্যা আনুমানিক ৭টার দিকে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনার, কোতোয়ালি জোনের দায়িত্বপ্রাপ্ত আরিফুজ্জামান আরিফ রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আসেন এবং আমাকে বলেন ‘তুমি লাশ দেখেছো?’ জবাবে আমি বলি, না স্যার, আমি লাশ দেখিনি। তারপর তিনি বলেন, ‘তুমি লাশ দেখে আসো।’ আমি লাশ দেখে এসে আরিফুজ্জামান স্যারকে বলি— লাশের শরীরে অসংখ্য ছররা গুলির আঘাত আছে এবং মাথার পেছনে ক্ষত চিহ্ন আছে, সেখান থেকে রক্ত বের হচ্ছে— যা স্ট্রেচারে রক্ত মাখা অবস্থায় আছে। আরিফুজ্জামান স্যার আমাকে বলেন, ‘সুরতহালে ছররা গুলির আঘাতের কথা লেখা যাবে না।’ আমি তার কথায় একমত পোষণ না করলে তিনি আমাকে গালিগালাজ শুরু করেন এবং বলেন, ‘ব্যাটা তুই কথা শুনবি না? কথা না শুনলে তোকে জামায়াত-শিবির হিসেবে চালান করে দেবো।’ তখন রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যায়। এসি আরিফুজ্জামান স্যার আমাকে বলেন, ‘আমার ওপরে চাপ আছে, তোকে এটা করতেই হবে।’ আমি তার কথায় আবারও রাজি না হয়ে বলি— তার কথা মতো সুরতহাল প্রস্তুত করলে পরবর্তীকালে আমার সমস্যা হতে পারে। তিনি এ কথা শুনে আরও রেগে গিয়ে আমার মৃত বাবা-মা তুলে গালিগালাজ শুরু করেন এবং বলেন, ‘তোকে আওয়ামী লীগের লোক দিয়ে মেরে ফেলবো’। তখন আমি ভয় পেয়ে যাই।

banner

‘রাত আনুমানিক ১০টা ৩০ মিনিটের দিকে এসি আরিফুজ্জামান স্যার একজন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটকে সঙ্গে নিয়ে আসেন। পুনরায় আমাকে সুরতহাল প্রস্তুত করতে চাপ প্রয়োগ করেন। আমি উপায়ান্তর না দেখে রংপুর মেট্রোপলিটনের এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদ সাদাতের উপস্থিতিতে আবু সাঈদের সুরতহাল রিপোর্টে ছররা গুলির কথা বাদ দিয়ে, শরীরে অসংখ্য ছোট ছোট ক্ষত চিহ্ন এবং মাথায় আঘাতের চিহ্ন লিখে সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত করতে বাধ্য হই।

এই সেই আমার প্রস্তুতকৃত সুরতহাল প্রতিবেদনের সত্যায়িত ফটোকপি, যাতে প্রস্তুতকারী হিসেবে আমার স্বাক্ষর আছে (সুরতহাল রিপোর্ট সাক্ষীকে দেখানো হলে)। এই সেই সুরতহাল রিপোর্টের সত্যায়িত ফটোকপি এবং উহাতে আমার স্বাক্ষর যা যথাক্রমে প্রদর্শণী ৭ এবং ৭(ক) হিসেবে চিহ্নিত হলো।

সাক্ষী তরিকুল ইসলাম আরও বলেন, পরে সুরতহাল রিপোর্টে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদ সাদাত প্রতি স্বাক্ষর করেন এবং মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ণয়ের জন্য আমি আবু সাঈদের লাশ রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠাই। এই ত্রুটিপূর্ণ সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করতে আমাকে বাধ্য করা হয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। এটা আমার জবানবন্দি।

এর আগে, আবু সাঈদ হত‍্যা মামলায় গত ২৪ জুন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় তদন্ত সংস্থা। এ ঘটনায় মোট ৩০ জনকে আসামি করা হয়।

পরে গত ৩০ জুন মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। এছাড়া পলাতকদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়।

গত ১৩ জুলাই এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্য মামলায় গ্রেফতার রাসেল ও পারভেজকে ট্রাইব্যুনালে হাজিরের নির্দেশ দেওয়া হয়। একইসঙ্গে পলাতক ২৪ জনকে গ্রেফতারের মাধ্যমে আদালতে হাজির করতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-২।

গত ২২ জুলাই এ মামলায় বেরোবির সাবেক ভিসি, রংপুর মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনারসহ পলাতক ২৪ আসামির পক্ষে স্টেট ডিফেন্স নিয়োগ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।

পরে প্রসিকিউটর প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম বলেছিলেন, এ মামলায় ৩০ আসামির মধ্যে এখনও ২৪ জন পলাতক। তাদের বিরুদ্ধে দুটি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। তবে আদালতে হাজির না হওয়ায় পলাতক হিসেবেই এসব আসামির বিচারকাজ চলবে। আর গ্রেফতার ছয়জনের দুজন এখনও আইনজীবী নিয়োগ দেননি। তাদের ব্যাপারে ট্রাইব্যুনাল জানতে চেয়েছেন। এছাড়া পলাতক ২৪ জনের পক্ষে সরকারি খরচে চারজন স্টেট ডিফেন্স নিয়োগ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। অর্থাৎ ছয়জনের জন্য একজন করে আইনজীবী লড়বেন। গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন নির্মূলে আওয়ামী লীগ সরকার, তার দলীয় ক্যাডার ও সরকারের অনুগত প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত করে বলে, একের পর এক অভিযোগ জমা পড়ে।

“সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন”

এই সম্পর্কিত আরো পোস্ট দেখতে পারেন

কমেন্ট লিখুন