Home » ‘মব সন্ত্রাস’ থামাবে কে?

‘মব সন্ত্রাস’ থামাবে কে?

0 মন্তব্য গুলি 3 জন দেখেছে 4 মিনিট পড়েছেন

সরকারের নানা পদক্ষেপ ও প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও বীভৎস রূপে দেখা দিয়েছে ‘মব সন্ত্রাস’। একের পর এক মব ভায়োলেন্সের ঘটনা জনমনে গভীর উদ্বেগ তৈরি করছে। সর্বশেষ রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে কবর থেকে লাশ তুলে এলোপাতাড়ি আঘাত ও প্রকাশ্যে উল্লাস করে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা সব ধরনের বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। একের পর এক মব সন্ত্রাসের ঘটনা নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে পর্যবেক্ষক মহলের পাশাপাশি সচেতন জনগোষ্ঠীকেও। কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা সরকারের দায়িত্বশীলদের ভূমিকা বা সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন।

তারা বলছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতি বা প্রেক্ষাপটের সুযোগ নিয়ে অনেকে ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত বা রাজনৈতিক স্বার্থে মব সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মব সন্ত্রাস দমনে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে না। এ কারণে মব সন্ত্রাসের প্রবণতাও বাড়ছে। যদিও পুলিশের আইজি বাহারুল আলম খবরের কাগজকে গতকাল বলেছেন, মব ভায়োলেন্স প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বাধ্য করা হলে প্রয়োজনে সর্বোচ্চ বল প্রয়োগ করা হবে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, গত এক বছরে (২০২৪-এর আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের আগস্ট) মব সন্ত্রাসের শিকার হয়ে ২২০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে গত বছরের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৯৬ জন এবং চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ১২৪ জন। চলতি বছরের গত আট মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিহতের সংখ্যাও গত আগস্টে, যেখানে মৃতের সংখ্যা ২১।

এসবের বাইরেও মব ভায়োলেন্সের মাধ্যমে আহত বা স্থাপনায় হামলা-ভাঙচুরের বহুসংখ্যক ঘটনা ঘটেছে গত এক বছরে। জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দফায় দফায় ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ, হাটহাজারীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও স্থানীয় গ্রামবাসীর সংঘাত, রাজশাহীতে মাজারে হামলা-ভাঙচুর, বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমানের বাড়ির সামনে অবস্থান নিয়ে অশালীন স্লোগান, আদালতের এজলাসের ভেতর সাংবাদিকদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করাসহ বিভিন্ন স্থানে মব ভায়োলেন্সের ঘটনা ঘটেছে। বেশ কয়েক মাস একটু কম থাকলেও গত এক সপ্তাহে মব সন্ত্রাসের ঘটনা আবার নতুন করে আলোচনায় এসেছে। বলা হচ্ছে, সরকারকে কেউ তোয়াক্কা করছে না। আবার কারও মতে, নির্বাচন বানচাল করার জন্য একটি মহল গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তারাই নেপথ্যে ভূমিকা পালন করে দেশ অস্থিতিশীল করে তুলছে।

banner

অপরাধই বাড়তে থাকে। এর মানে আবার এই নয় যে রাজনৈতিক শক্তি বা দল ছাড়া সরকার চালানো যায় না। তবে রাজনৈতিক সরকার অবশ্যই তুলনামূলক ভালোভাবে দেশ চালাতে পারে। কারণ তাদের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি থাকে।’

তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক শক্তি বা সমর্থন ছাড়া কেবল পুলিশ দিয়ে মব সন্ত্রাস দমন করা যাবে না। ফলে নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক শক্তির হাতে দেশের দায়িত্ব পড়লেই কেবল মব সন্ত্রাসের মতো অপরাধ কমে যাবে।’

এ বিষয়ে গতকাল সাবেক আইজিপি আব্দুল কাইয়ুম খবরের কাগজকে বলেন, অনেকে বর্তমান সময় ও পরিস্থিতির সুযোগ কাজে লাগিয়ে মব সন্ত্রাস ঘটাচ্ছে। বর্তমানে আইনশৃঙ্খলায় ‘হযবরল’ অবস্থা বিরাজ করছে। মব ভায়োলেন্স দমনে যে দৃঢ় মনোবল থাকার দরকার, সেটার অভাব দেখা যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারের মধ্যেও কোথাও কোথাও ‘ব্যবধান’ দেখা যাচ্ছে। সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতনরা মুখে বলছেন, ‘মব ভায়োলেন্স সহ্য করা হবে না।’ কিন্তু বাস্তবে তার কোনো নিদর্শন দেখা যাচ্ছে না। এসব কারণে মূলত মব সন্ত্রাসের ঘটনা বাড়ছে।

গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যাবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সাবের আহমেদ চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে মব সন্ত্রাসের ঘটনা বাড়ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর পদক্ষেপের অভাবও মব সন্ত্রাস বেড়ে যাওয়ার অন্যতম একটি কারণ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনেক সময় এসব দমাতে পারছে না বা সক্ষমতাও দেখাতে পারছে না। কিছু ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে একটু কঠোর পদক্ষেপ নিতে গেলেও সেখানে তারা সমালোচনার মুখে পড়ছে।

ড. সাবের আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘মবের এ ধরনের ঘটনা আগে আমাদের দেশে সেভাবে ছিল না। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে মব ভায়োলেন্সের ঘটনা প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকে। সরকারের ইন্ধনে এগুলো ঘটেছে, তা বলব না। তবে মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে সেভাবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলাফল হিসেবে মব সন্ত্রাসের ঘটনা শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে গেছে। ব্যক্তি স্বার্থে, গোষ্ঠী স্বার্থে এবং এমনকি রাজনৈতিক স্বার্থেও আমরা মব ভায়োলেন্সের ঘটনা দেখছি, যেটি বাংলাদেশের সমাজে কোনোভাবেই কাম্য নয়। যেভাবেই হোক, মব সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় আগামীতে মবের প্রবণতা আরও বাড়বে।’

প্রেক্ষাপটে ঘটলেও বার্তাটি একটাই: মব ভয়ংকরভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, আর রাষ্ট্র তা প্রতিহত করতে পারছে না বা করছে না।’ প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উপস্থিত থেকেও কেন হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ হলো? যদি এটি দুর্বলতার ফল হয়, তবে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ভেঙে পড়ার প্রশ্ন উঠতে পারে। আর যদি ইচ্ছাকৃত নীরবতা থাকে, তবে তা একধরনের প্রচ্ছন্ন সমর্থনের ইঙ্গিত। উভয় অবস্থাই ভীতিকর।

আবু আহমেদ ফয়জুল কবির বলেন, সরকার মাঝেমধ্যে বিবৃতি দিয়ে দায়সারা নিন্দা প্রকাশ করলেও গত ১৩ মাসে মব সন্ত্রাস প্রতিহত করতে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে পারেনি। অথচ রাষ্ট্রের দায়িত্ব শুধু প্রতিক্রিয়া জানানো নয়, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা এবং নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সরকার নিন্দা জানানোর চর্চা থেকে বেরিয়ে এসে কঠোর ও কার্যকর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করুক। নইলে এই নীরবতা বা অক্ষমতা একদিন রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলবে।

করছি। মানবিক পুলিশিং প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছি। কিন্তু অনেকেই সেটার সুযোগ নিচ্ছেন। আইন না মানার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। মব ভায়োলেন্স ঠেকাতে পুলিশ চেষ্টা করে যাবে। তবে বাধ্য করা হলে প্রয়োজনে সর্বোচ্চ বল প্রয়োগ করা হবে।’

অন্যদিকে গতকাল দুপুরে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এতদিন যেমনই ছিল, কিন্তু গত কয়েক দিনের ঘটনায় ‘একটুখানি’ খারাপের দিকে গেছে। তবে এটা যাতে সম্পূর্ণ আগের জায়গায় নিয়ে আসতে পারি, সেই চেষ্টা করব।’

“সুত্র: দৈনিক খবরের কাগজ”

এই সম্পর্কিত আরো পোস্ট দেখতে পারেন

কমেন্ট লিখুন