বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গন আজ এক গভীর পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সের এই প্রজন্ম গত ১৭ বছর ধরে এমন এক বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে, যা তাদের রাজনৈতিক বোধ, আস্থা ও প্রত্যাশাকে আমূল বদলে দিয়েছে। তারা প্রত্যক্ষ করেছে কিভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বুলি আউড়াতে আউড়াতে দেশে লুটপাট, দুর্নীতি, ভোটাধিকার হরণ, বিচারহীনতা ও দমন-পীড়নের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছিল। উন্নয়নের নামে অধিকার হরণ আর স্বৈরাচারী শাসনের চর্চা এই প্রজন্মের চোখে শাসকগোষ্ঠীর স্বরূপ উন্মোচিত করেছে।
এই প্রজন্মের চোখের ভাষায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে—তারা আর পুরনো রাজনৈতিক ন্যারেটিভে বিশ্বাস করে না।
আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ন্যারেটিভ কৌশল মূলত তিনটি শব্দের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল—‘শেখ মুজিব জাতির পিতা’, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ এবং ‘জামায়াত-শিবির-জঙ্গি’। দীর্ঘদিন ধরে এই তিনটি শব্দকে তারা রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। কিন্তু এই প্রজন্ম যখন দেখল শেখ মুজিবের ছবি টাঙিয়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে দেশে অনিয়ম, দমন-পীড়ন ও দুর্নীতির মহোৎসব চলছে, তখন তাদের কাছে এই ন্যারেটিভ অর্থহীন হয়ে পড়ল।
আর যখন আওয়ামী লীগবিরোধীদের রাজাকার আখ্যা দিলেন শেখ হাসিনা, তখন এই প্রজন্ম সেই শব্দকে উল্টো ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের প্রতীকে রূপান্তর করল। রাজাকার শব্দ হয়ে উঠল প্রজন্মের প্রতিবাদের ভাষা— ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে বিদ্রুপ ছুড়ে দেওয়ার হাতিয়ার।
কিন্তু সমস্যা এখানেই শেষ হয়নি। বিএনপি কিংবা বাম দলগুলোও যখন একই ভাষা ব্যবহার করল—তখন এই প্রজন্মকে বিএনপি বা সমাজতন্ত্রীদের আওয়ামী লীগের প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখাতে শুরু করল দক্ষিণপন্থীরা।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রচলিত রাজনৈতিক ভাষ্য তাদের কাছে হাস্যকর ও অবিশ্বাসযোগ্য করে তোলা হলো। প্রজন্মকেও বোঝানো হলো, বিএনপি আর আওয়ামী লীগ একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ, আর বামপন্থীরাও আওয়ামী লীগের হয়ে কাজ করছে। বিএনপিসহ বাম দলগুলো দক্ষিণপন্থীদের প্রচার করা এই ন্যারেটিভকে অতটা শক্তভাবে আমলে নেয়নি। ফলে অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থার এগিয়ে চলা সহজ করেছে। আর প্রজন্মের কাছেও বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল আস্থা হারিয়েছে; কারণ তারা এই প্রজন্মের সত্যিকার আবেগ-অনুভূতি, প্রত্যাশা-হতাশা আর আকাঙ্ক্ষা বুঝতে পারেনি।
ডাকসু এবং জাকসু নির্বাচনে আমরা তারই বাস্তব প্রমাণ দেখেছি। সেখানে জামায়াত-শিবির প্রভাব বিস্তার করেছে, এমনকি নারী শিক্ষার্থীরাও তাদের ভোট দিয়েছেন। কারণ ছাত্রদল বা অপরাপর সংগঠনকে তাঁরা ছাত্রলীগের মতো একই চরিত্রের সংগঠন হিসেবে দেখেছেন। মূল সমস্যা হলো—বিরোধী ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতারা নিয়মিত ছাত্র হয়ে ক্যাম্পাসে উপস্থিতি কম, সাধারণ শিক্ষার্থীর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে পারেননি। তাঁরা শিক্ষার্থীদের সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়াননি, মতামত শোনেননি, নিজেদের সংশোধনের চেষ্টা করেননি। নারী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও একই সংকট ছিল। যেখানে ছাত্রী সংস্থা সক্রিয় ছিল, সেখানে ছাত্রদলের নেত্রীরা ছাত্রীদের ভেতরে উপস্থিত থাকতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে নারী শিক্ষার্থীরাও বিকল্প হিসেবে শিবিরের দিকে ঝুঁকেছেন—তার মানে এই নয় যে তাঁরা শিবির হয়ে গেছেন।
জামায়াত-শিবির দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ শিক্ষার্থীর পাশে থাকার কৌশল অবলম্বন করেছে। তারা নিয়মিত ছাত্র, ক্লাসে উপস্থিত থাকে, আবাসন, পড়াশোনা বা ব্যক্তিগত সমস্যায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। এ কারণে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে তারা সহজলভ্য ও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। এর বিপরীতে ছাত্রলীগের সন্ত্রাস, দখলদারি ও চাঁদাবাজির ইতিহাস এখনো শিক্ষার্থীদের মনে ভীতির সঞ্চার করে। শিবির এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ছাত্রদলকেও ছাত্রলীগের মতো করে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে—যে তারাও ক্ষমতাকেন্দ্রিক ও সহিংস রাজনীতির ধারক। এভাবে ছাত্রদল তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে, আর শিবির সংগঠিত শক্তি হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই প্রজন্মের রাজনৈতিক মনস্তত্ত্ব। এই প্রজন্ম চোখের সামনে দেখেছে ভোটাধিকার হরণের রাজনীতি, গুম-খুনের রাজনীতি, ভিন্নমতের দমন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং দুর্নীতির মহামারি। তারা আর প্রচলিত রাজনৈতিক শব্দ বা ন্যারেটিভে আস্থা রাখে না। তাদের কাছে স্বাধীনতার প্রকৃত মানে হলো ভোটাধিকার, ন্যায়বিচার, সমান সুযোগ এবং মানবিক মর্যাদা। তারা চায় রাজনীতি হোক মানুষের পাশে থাকার, তাদের সমস্যা সমাধান করার, তাদের চোখের ভাষা বোঝার হাতিয়ার।
নারী শিক্ষার্থীদের ভোটের আচরণও এই সংকটকে স্পষ্ট করে দেয়। তাঁরা দেখেছেন ছাত্রদলের নেত্রীরা ছাত্রীদের ভেতরে নেই, তাঁদের সমস্যার পাশে দাঁড়াচ্ছেন না। অন্যদিকে শিবির অন্তত নিয়মিত ছাত্রীদের মাধ্যমে ছাত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। তাই নারীরাও বিকল্প খুঁজতে গিয়ে শিবিরকে বেছে নিয়েছেন। এটি শুধু ছাত্রদলের নয়, সামগ্রিক বিরোধী রাজনীতির জন্যও একটি সতর্কবার্তা।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৮ থেকে ৩৬ বছর বয়সী ভোটারদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, প্রায় অর্ধেক। যারা গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় ছিল, তাদের জীবনদান ও লড়াইয়ের কারণে আজ বাংলাদেশ স্বৈরাচারমুক্ত। এই তরুণরা নিশ্চয়ই নতুন কোনো স্বৈরাচারকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসাবে না—এটি সবার মনে রাখা উচিত। নেপালের প্রজন্ম এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে সরকারি ও বিরোধী উভয় দলকেই কঠোরভাবে পিটুনি দিচ্ছে— এটাও স্মরণ রাখা দরকার।
সব কিছু মিলিয়ে এই প্রজন্মের চোখের ভাষা বুঝতে হবে। তারা শুধু স্লোগান, ইতিহাস বা প্রতীক শুনতে চায় না; তারা চায় বাস্তবতায় রাজনীতি হোক তাদের জীবনের অংশীদার। যে রাজনীতি তাদের পাশে থাকবে, তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেবে, তাদের সমস্যা সমাধান করবে, সেই রাজনীতিই তারা গ্রহণ করবে। আওয়ামী লীগের তৈরি ব্লেইমভিত্তিক ন্যারেটিভ ভেঙে পড়েছে, বিএনপি ও বামরাও এই প্রজন্মে আস্থা অর্জন করতে পারেনি, আর এই শূন্যতায় জামায়াত-শিবির সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু এ পরিস্থিতি স্থায়ী নয়। যদি বিরোধী দলগুলো সত্যিকার অর্থে এই প্রজন্মের চোখের ভাষা পড়তে পারে, তবে তারা আবারও আস্থা অর্জন করতে পারে। আগামী দিনের রাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে এই প্রজন্ম।
লেখক : যুগ্ম সম্পাদক, দৈনিক কালের কণ্ঠ