তৃণমূলের সংবাদ ডেস্ক:
বাংলাদেশের নদ-নদীর সঙ্গে চরভিত্তিক জীবন এক গভীর বন্ধনে বাঁধা। বিশেষ করে নদীপারের মানুষদের জীবন ও জীবিকা—দুটোই চরের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। শুকনো মৌসুমে উত্তরাঞ্চলের প্রতিটি চর যেন একেকটি সোনার খনিতে পরিণত হয়। সোনা না থাকলেও এখানে জন্ম নেয় তার থেকেও মূল্যবান সম্পদ—অজস্র ফসল। প্রকৃতি এখানে দু’হাত ভরে দিয়েছে। উত্তরাঞ্চলের চরগুলো দেশের সবজির বড় একটি অংশের চাহিদা পূরণ করছে। শুধু ফসলই নয়, চরভূমি হলো গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়ার জন্যও এক স্বর্গ। এ যেন জীবিকার স্বাভাবিক সম্ভাবনার এক উন্মুক্ত ভাণ্ডার। তবু এই মানুষগুলো থাকে খুব সাধারণ জীবনযাত্রার মধ্যে, সরল আর কঠিন সংগ্রামের ভেতর। তাদের প্রতিদিনের জীবন রাজনীতির ক্ষমতার খেলা বা নগরকেন্দ্রিক হৈচৈয়ের বাইরে, অনেকটা নীরব সংগ্রাম আর প্রাকৃতিক অনিশ্চয়তার সঙ্গেই কাটে। সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুরের লাউতারা বাথানে প্রায় অর্ধশত গরু নিয়ে যাচ্ছিলেন রবিউল। শুকনো মৌসুমের কয়েকটি মাস তিনি সেখানেই থাকেন বললেন আলাপচারিতায়। খড়ের ছাউনি তুলে তৈরি করেন অস্থায়ী আশ্রয়। রান্না-খাওয়া সবকিছু হয় সেই চরে। দিনের পর দিন গরুগুলো তৃপ্তি করে চরাঞ্চলের ঘাস খায়, আর অবসর সময়ে রবিউলও অন্যদের সঙ্গে হাসি-তামাশায় কাটিয়ে দেন সময়। শুধু রবিউল নন, তার মতো আরও অসংখ্য মানুষ এভাবেই চরভিত্তিক বাথানজীবন গড়ে তুলেছেন। এ যেন উত্তরাঞ্চলের এক অঘোষিত সামাজিক উৎসব—অস্থায়ী হলেও প্রাণবন্ত ও পরিশ্রমনির্ভর। একসময় ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, তিস্তা আর পদ্মার মতো বৃহৎ নদীগুলো ছিল কেবলই দুঃখের নাম—ভাঙন, ক্ষতি আর নিঃস্বতার প্রতীক। কিন্তু আজ সেই নদীর বুকে জেগে ওঠা চরেই নতুন জীবন খুঁজে পেয়েছে মানুষ। অক্লান্ত পরিশ্রমে চাষিরা বেলে মাটিতে ফলাচ্ছেন সবজি ও নানা ফসল, বদলাচ্ছেন তাদের ভাগ্য। যে ভূমিহীন পরিবারগুলো একদিন নদীর গর্ভে জমি-ভিটে হারিয়েছেন, তারাই এখন নদীর বুক থেকে নতুন সম্ভাবনার ফসল ঘরে তুলছেন। এখন এই নদীগুলোর অসংখ্য চরে জন্ম নিচ্ছে শাক-সবজি, ধান, ভুট্টা ও নানা প্রকার ফসল। কৃষি আর গবাদিপশু পালন চরবাসীর জন্য কেবল আয়ের পথই নয়, হয়ে উঠছে জীবনের নতুন সংজ্ঞা। ভাঙনই যে শেষ নয়, তার প্রমাণ দিচ্ছে এই চরবাসী—বেঁচে থাকার অন্বেষণকে তারা রূপ দিচ্ছেন উন্নয়নের গল্পে। ইরিগেশন সাপোর্ট প্রজেক্ট ফর এশিয়া অ্যান্ড নিয়ার ইস্ট (ইসপান) তাদের এক প্রতিবেদনে দেখিয়েছে, দেশের প্রধান পাঁচটি নদীতে চরের মোট আয়তন প্রায় ১,৭২২ দশমিক ৮৯ বর্গকিলোমিটার। অর্থাৎ দেশের মোট জমির প্রায় ১ দশমিক ১৬ শতাংশই এই চরভূমি। এর মধ্যে সবচেয়ে বিস্তৃত চর রয়েছে উত্তরাঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র-যমুনা অববাহিকায়—৯৮৭ দশমিক ৬০ বর্গকিলোমিটার। পদ্মা অববাহিকায় চরভূমির পরিমাণ ৫০৮ দশমিক ২৭ বর্গকিলোমিটার আর মেঘনার উত্তর ও দক্ষিণ অববাহিকায় ২২৬ দশমিক ৭৫ বর্গকিলোমিটার। এই বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে বাস করছে অন্তত সাত লাখ মানুষ, যার অর্ধেকেরও বেশি—প্রায় চার লাখ—যমুনা নদীর চর এলাকায়। ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা ও যমুনার বুক জুড়ে অসংখ্য ছোট-বড় চরে এখন জন্ম নিচ্ছে নতুন জনবসতি, গড়ে উঠছে গবাদিপশুর ছোট ও মাঝারি খামার। অতীতে যে জায়গাগুলো ছিল কেবল ভাঙনের বেদনা ও অনিশ্চয়তার প্রতীক, সেখানেই আজ নতুন গ্রাম, নতুন অর্থনীতি গড়ে উঠছে। ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও পদ্মাসহ শাখানদীর ভাঙনে বহু পরিবার হারিয়েছে ঘর-বাড়ি, ফসলি জমি—অর্থাৎ ভূমিহীন ও নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। দারিদ্র্য ও অভাব তখন ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী। কিন্তু আজ সেই চিত্র বদলে গেছে। কয়েক বছরের মধ্যেই যেখানে ছিল শুধুই বালুচর, সেই চরে বন্যায় জমে থাকা পলিমাটি আজ উর্বর আবাদি জমিতে পরিণত হয়েছে।
দীর্ঘ বিস্তীর্ণ বালুচরে এখন সযত্নে চাষ হচ্ছে সরিষা, ধান, গম, ভুট্টা, বাদাম, মিষ্টি আলু, তিল, তিসি, পেঁয়াজ, রসুন, লাউ, গাজর, মরিচ, হলুদ, শসা, সিম, কুমড়া এবং নানান ধরনের শাক-সবজি। যে জায়গা দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত ছিল, যেখানে ঘাসও জন্মাত না, সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করে তুলেছেন চরের কৃষকেরা।
চরের বেলে দো-আঁশ মাটিতে ডাল জাতীয় ফসলও প্রচুর পরিমাণে আবাদ হচ্ছে—মাসকালাই, খেসারি, ছোলা। গবাদিপশুর ছোট খামার ও নতুন জনবসতির জন্মও এখন চরের স্বাভাবিক চিত্র। এই চরের কৃষি ও পশুপালন বিপ্লব কেবল স্থানীয় মানুষের জীবনমান উন্নত করছে না, বরং পদ্মা ও যমুনার বুক জুড়ে জেগে ওঠা চরগুলোর অর্থনৈতিক সম্ভাবনার চিত্রও সম্পূর্ণভাবে পাল্টে দিতে পারে।
আকার বৃদ্ধি পাওয়ায় কেবল অস্থায়ী নয়, স্থায়ী চরে পরিণত হচ্ছে জায়গাগুলো। জনবসতিহীন দুর্গম চরে এখন বসেছে প্রাণের মেলা।
চরের মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেকেরই রয়েছে গরু-মহিষ-ছাগলের ছোটখাটো খামার। গবাদি পশু লালন-পালনের মাধ্যমে চরাঞ্চলের অর্থনীতি এখন ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় যদি একটি সুপরিকল্পিত উদ্যোগ শুরু হয়, তবে এই সম্ভাবনা বাস্তবে রূপ নিতে পারে—অভাব ঘুচবে চরবাসীর, উৎপাদন বাড়বে দুধ ও দুগ্ধজাত সামগ্রীর আর এতে অর্থনৈতিক বিপ্লবও সম্ভব হবে।
সিরাজগঞ্জের চৌহালীর স্থল ইউনিয়নের গোসাইবাড়ি চরের শুকুর ব্যাপারী বলছিলেন, তিন বছর আগে সংসারে অভাব-অনটন ছিল নিত্যসঙ্গী। কর্মসংস্থান শূন্য। বাধ্য হয়ে পরিবার নিয়ে যমুনা চরে এসে নতুন বসতি গড়ে তোলেন। গরু পালন করে আজ তিনি সম্পূর্ণভাবে স্বাবলম্বী; বর্তমানে চারটি গরু নিয়ে একটি ছোট খামার গড়ে তুলেছেন। তার সংসারে আর কোনো অভাব-অনটন নেই এখন।
খাষপুখুরিয়া ইউনিয়নের কোদালিয়াচরের ময়নাল সিকদার, রজব আলী, উমরপুরচরের আবু ছাইদ ও কোরবান আলী বলছিলেন, চর এলাকায় খোলামেলা পরিবেশে গবাদি পশু পালন করলে রোগ-বালাই কম হয়। পলিমাটির আস্তরণে জেগে ওঠা ঘাস-বিচালি দিয়ে তারা গবাদি পশু লালন করছেন, আর এজন্যই চরে ছোটখাটো গবাদিপশুর খামার দ্রুত বেড়ে উঠছে।
একসময় নদীগুলো তাদের সব কিছু কেড়ে নিয়েছিল। কিন্তু এখন নদীর বুক থেকে চর জেগে ওঠায় মানুষরা ধীরে ধীরে ফিরে এসেছে, হারানো গ্রামের নাম ধরে নতুন বসতি গড়ে তুলছে। তবে চরে বসবাসরত ছেলে-মেয়েরা এখনো শিক্ষা ও চিকিৎসার সুবিধা থেকে বঞ্চিত। লেখাপড়ার জন্য নেই কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। স্বাস্থ্যসেবা প্রায় নেই বললেই চলে। এটি চরাঞ্চলের সামাজিক ন্যায্যতার একটি বড় ফাঁক।
নদীভাঙা অভাবী শত শত পরিবার নদীর বুকে জেগে ওঠা বালুচরকে কাজে লাগিয়ে তাদের জীবনের অভাব দূর করছে। এই সব পরিবারের নারীরাও স্বামী ও সন্তানদের সঙ্গে মিলেমিশে কঠোর পরিশ্রম করে নানা ফসল ফলাচ্ছেন। সেই ফসল বিক্রি করে তারা স্বচ্ছলতা ও সফলতার স্বাদ পাচ্ছেন। চলতি মৌসুমে ফসল ফলানোর সঙ্গে সঙ্গে চাষিদের মুখে দেখা যাচ্ছে সাফল্যের হাসি।
যদি এই অবস্থা বজায় থাকে, তবে সম্ভাবনাময় চরের কৃষি ও গবাদিপশুর খামারগুলো দেশের অর্থনৈতিক চিত্রটাকে বদলে দিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
“সুত্র: বিডিনিউজ২৪.কম অনলাইন”