Home » জরায়ুর ফাইব্রয়েড চিকিৎসায় যুগল ওষুধের নতুন দিগন্ত

জরায়ুর ফাইব্রয়েড চিকিৎসায় যুগল ওষুধের নতুন দিগন্ত

নারীদের নীরব কষ্ট

0 মন্তব্য গুলি 6 জন দেখেছে 4 মিনিট পড়েছেন

নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এমন একটি স্বাস্থ্য সমস্যা হলো জরায়ুর ফাইব্রয়েড (Uterine fibroid বা Leiomyoma)। এটি ক্যান্সার নয়, কিন্তু এর প্রভাবে একজন নারীকে দীর্ঘদিন ভোগান্তি পোহাতে হয়।
• প্রচণ্ড পেটব্যথা,
• অস্বাভাবিক মাসিক রক্তক্ষরণ,
• অ্যানিমিয়া (রক্তশূন্যতা),
• এমনকি বন্ধ্যাত্ব—এসবই ফাইব্রয়েডের কারণে ঘটে।
ফাইব্রয়েডের কারণে সম্ভাব্য অতিরিক্ত সমস্যা
• পেট বা তলপেটে চাপ অনুভব → বড় ফাইব্রয়েড আশপাশের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে চাপ সৃষ্টি করে।
• প্রস্রাবে সমস্যা → জরায়ুর ভেতরের ফাইব্রয়েড মূত্রথলিকে চেপে ধরে, ফলে ঘন ঘন প্রস্রাবের চাপ আসে বা সম্পূর্ণ প্রস্রাব না হওয়ার অনুভূতি হয়।
• কোষ্ঠকাঠিন্য → ফাইব্রয়েড যদি রেকটাম বা অন্ত্রের কাছে হয়, তবে স্বাভাবিক মলত্যাগে সমস্যা হয়।
• পেট ফুলে যাওয়া বা ভারী লাগা → বড় আকারের ফাইব্রয়েডে পেট স্থায়ীভাবে ফোলা দেখাতে পারে।
• পিঠে বা কোমরে ব্যথা → ফাইব্রয়েড আশপাশের স্নায়ুতে চাপ দিলে এই ব্যথা হয়।
• গর্ভধারণে জটিলতা → গর্ভপাত, প্রি-টার্ম ডেলিভারি (সময়ের আগেই সন্তান জন্ম), বা ভ্রূণের বৃদ্ধিতে সমস্যা তৈরি করতে পারে।
• যৌনমিলনে ব্যথা (Dyspareunia) → বিশেষ করে জরায়ুর ভেতরের (submucosal) ফাইব্রয়েড থাকলে।
• অতিরিক্ত রক্তক্ষরণজনিত জটিলতা → দীর্ঘদিন রক্তশূন্যতায় ক্লান্তি, দুর্বলতা, হৃদ্‌যন্ত্রে চাপ তৈরি হয়।

বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহু দেশে জরায়ুর ফাইব্রয়েডে আক্রান্ত হয়ে ভুগছেন কোটি কোটি নারী। এই রোগে অনেক সময় বছরের পর বছর ভোগান্তি পোহাতে হয়। প্রচণ্ড ব্যথা, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ কিংবা সন্তান ধারণে সমস্যার মতো জটিলতার কারণে এটি একটি বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
বর্তমানে চিকিৎসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রচলিত ভরসা হলো অস্ত্রোপচার। এর মধ্যে দুটি পদ্ধতি বেশি ব্যবহৃত হয়—
• মায়োমেক্টমি (Myomectomy): জরায়ু অক্ষত রেখে শুধু ফাইব্রয়েড অপসারণ করা হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রে সময়ের সাথে সাথে নতুন ফাইব্রয়েড তৈরি হতে পারে।
• হিস্টেরেক্টমি (Hysterectomy): পুরো জরায়ুই কেটে ফেলা হয়। এতে ফাইব্রয়েডের সমস্যা আর থাকে না, কিন্তু একইসাথে নারীর ভবিষ্যৎ মাতৃত্বের সুযোগও চিরতরে হারিয়ে যায়।
এই দুই ধরনের অস্ত্রোপচারই বেশ ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যেখানে সার্জারি করার মতো পর্যাপ্ত চিকিৎসা অবকাঠামো নেই, সেখানে নারীদের জন্য এটি আরও বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। অনেক নারী দেরিতে চিকিৎসা নেন বা আর্থিক অক্ষমতার কারণে চিকিৎসা নিতে পারেন না।
তাছাড়া, অস্ত্রোপচারের পর দীর্ঘ সময় বিশ্রামের প্রয়োজন হয়, কাজের ব্যাঘাত ঘটে এবং মানসিক চাপও তৈরি হয়। ফলে চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে সার্জারি এখনো পর্যন্ত কার্যকর হলেও এটি রোগীদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সমাধান দিতে পারছে না।
বিশ্বব্যাপী প্রাদুর্ভাব
• গবেষণা অনুযায়ী, ৪০–৫০ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে প্রায় ৭০–৮০% পর্যন্ত নারী জীবনের কোনো না কোনো সময়ে ফাইব্রয়েডে আক্রান্ত হন।
• তবে অনেকের ক্ষেত্রে উপসর্গ তেমন প্রকাশ পায় না। গড়ে প্রায় ২৫–৩০% নারী-এর ক্ষেত্রে ফাইব্রয়েড এতটাই গুরুতর হয় যে চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে।
• উন্নয়নশীল দেশে সঠিক ডায়াগনোসিস কম হওয়ায় প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
অস্ত্রোপচারের প্রয়োজনীয়তা
• যুক্তরাষ্ট্রে জরায়ুর ফাইব্রয়েড নারীদের সবচেয়ে বেশি হিস্টেরেক্টমির কারণ (প্রায় ৩৫–৪০% কেসে)।
• বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ায়ও ফাইব্রয়েড অপারেশনের হার দ্রুত বাড়ছে, যদিও নির্ভুল পরিসংখ্যান সীমিত।
মাতৃত্ব ও জীবনের প্রভাব
• গুরুতর উপসর্গে ভোগা রোগীদের মধ্যে প্রায় ২০–২৫% নারী বন্ধ্যাত্ব সমস্যায় আক্রান্ত হন।
• অতিরিক্ত রক্তক্ষরণজনিত কারণে ৩০–৪০% রোগী অ্যানিমিয়ায় ভোগেন।

নতুন আশার খবর
যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স মেডিসিন ও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ (NIH)-এর গবেষক দল একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার করেছেন। তাঁরা দেখিয়েছেন—দুটি বহুল ব্যবহৃত ওষুধ একসাথে ব্যবহার করলে ফাইব্রয়েড কোষের বৃদ্ধি কার্যকরভাবে থামানো সম্ভব।
এই গবেষণার অন্যতম প্রথম লেখক বাংলাদেশি গবেষক সাদিয়া আফরিন, যিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত।

কোন ওষুধের যুগলবন্দি?
1. সিমভাস্টাটিন (Simvastatin)
o সাধারণত কোলেস্টেরল কমানোর জন্য ব্যবহার হয়।
o এটি কোষে কিছু বৃদ্ধির সংকেত (growth signalling) বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
2. মিফেপ্রিস্টোন (Mifepristone)
o প্রোজেস্টেরন হরমোনের কার্যকারিতা বন্ধ করে।
o প্রোজেস্টেরন রিসেপ্টরের (Progesterone receptor A ও B) মাধ্যমে ফাইব্রয়েড কোষ বাড়ে।
দুটি ওষুধ একসাথে ব্যবহার করলে প্রোজেস্টেরন রিসেপ্টর A ও B সিগন্যালিং পুরোপুরি দমন হয়। ফলে ফাইব্রয়েড কোষের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়।

banner

কেন এটা গুরুত্বপূর্ণ?
• বিশ্বের প্রতি ৩ জন নারীর মধ্যে অন্তত ১ জন জীবনের কোনো না কোনো সময় ফাইব্রয়েডে আক্রান্ত হন।
• বর্তমানে অস্ত্রোপচারই মূল সমাধান, যা ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ।
• সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী দুটি ওষুধের যুগল ব্যবহার যদি কার্যকর প্রমাণিত হয়, তবে এটি হবে অ-সার্জিক্যাল সমাধান।
• উন্নয়নশীল দেশে যেখানে অপারেশনের সুযোগ সীমিত, সেখানকার নারীদের জন্য এটি জীবন বদলে দেওয়ার মতো আবিষ্কার।

গবেষকদের মতামত
প্রধান গবেষক ড. বোরাহে বলেন,
“আমরা দীর্ঘদিন ধরে ফাইব্রয়েডের জন্য কার্যকর ওষুধ খুঁজছিলাম। এই গবেষণায় আমরা দেখেছি দুটি পরিচিত ওষুধ একত্রে ব্যবহার করলে এটি সত্যিই নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।”
এছাড়াও,
“বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীর অসংখ্য নারী ফাইব্রয়েডে ভুগছেন। যদি দুটি সহজলভ্য ওষুধ দিয়েই চিকিৎসা সম্ভব হয়, তবে তা নারীদের জন্য বিশাল স্বস্তি বয়ে আনবে।”

বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব
গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক জার্নালে এবং পাবমেড (PMID: 38649749, PMCID: PMC11035378)-এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
এই আবিষ্কার চিকিৎসা বিজ্ঞানের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কারণ—
• এটি ড্রাগ রি-পারপোজিং-এর একটি উদাহরণ (আগে ব্যবহৃত ওষুধকে নতুনভাবে কাজে লাগানো)।
• এটি ভবিষ্যতে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল-এর মাধ্যমে বাস্তবে প্রয়োগের সুযোগ তৈরি করবে।
• ফাইব্রয়েড চিকিৎসায় প্রথমবারের মতো সিনারজিস্টিক ওষুধ কম্বিনেশন প্রমাণিত হলো।

সারসংক্ষেপ
• জরায়ুর ফাইব্রয়েড নারীদের নীরব কষ্টের বড় কারণ।
• সিমভাস্টাটিন + মিফেপ্রিস্টোন যুগল ব্যবহার ফাইব্রয়েড বৃদ্ধির প্রধান সিগন্যাল বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে।
• এটি ভবিষ্যতে নারীদের জন্য অস্ত্রোপচার ছাড়া সহজ, নিরাপদ ও সাশ্রয়ী চিকিৎসার পথ তৈরি করতে পারে।
গবেষণাটি ওপেন একসেস হওয়াতে যে কেউ লিংকটিতে পূর্ণাঙ্গ আর্টিকেল টি পড়তে পারবেন: https://doi.org/10.1002/ctm2.1672

লেখক: সাদিয়া আফরিন, সাইন্টিস্ট, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ, বাল্টিমোর, মেরিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র।

এই সম্পর্কিত আরো পোস্ট দেখতে পারেন

কমেন্ট লিখুন