Home » ঈদে মিলাদুন্নবী (সঃ) : হোক ইবাদত, দোয়া ও মানবতার সেবায় পরিপূর্ণ একটি দিন

ঈদে মিলাদুন্নবী (সঃ) : হোক ইবাদত, দোয়া ও মানবতার সেবায় পরিপূর্ণ একটি দিন

প্রথম পর্ব---

0 মন্তব্য গুলি 127 জন দেখেছে 4 মিনিট পড়েছেন

রবিউল আউয়াল মাস উপলক্ষে উম্মতি মোহাম্মদী (সঃ) সহ বিশ্ব মানবতাকে আমাদের তৃণমূলের সংবাদ ডটকম পরিবারের পক্ষ থেকে মোবারকবাদ।

 ভূমিকা: চৌদ্দ শতাধিক বছর আগে, প্রায় ১৪৪৭ হিজরি পূর্বে, আরবের নির্জন মরুভূমি ও অন্ধকারে ঢাকা পৃথিবীতে উদিত হয়েছিল এক মহাজ্যোতি—সাইয়্যিদুল মুরসালিন, খাতামান্নাবিয়িন, রাহমাতাল্লিল আলামিন, শাফিউল মুজনেবিন, সরোয়ারে কায়েনাত, মুফাখ্খারে মৌজুদাত, দোজাহানের নবী, হযরত আহমদে মুজতবা, মুহাম্মদে মুস্তফা, ইমামুল ক্বিবলাতাইন, নূরনবী হুজুরে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)।

তাঁর জন্মের মাধ্যমে মানব ইতিহাসে শুরু হয় নতুন এক অধ্যায়। মানুষ পায় মুক্তির দিশা, দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত পৃথিবী পায় শান্তির বার্তা। ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন মানবসমাজ তাঁর নেতৃত্বে এক পতাকার নিচে ঐক্যবদ্ধ হয়।

তাঁর জন্মদিন মুসলিম উম্মাহর কাছে তাই শুধুই একটি তারিখ নয়; বরং এটি কৃতজ্ঞতা, আনন্দ ও আল্লাহর রহমতের প্রতীক। রাহমাতাল্লিল আলামিন-এর জন্মদিন স্মরণ ও পালন করা ঈমানের প্রকাশ, ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ এবং ইসলামী চেতনার পুনর্জাগরণ। এ কারণেই দিনটি বিশ্বজুড়ে পালিত হয় ঈদে মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামে। ইসলাম ধর্মের সর্বশেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্ম ও ওফাতের স্মৃতিবহ দিন হলো রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ। বাংলাদেশসহ বিশ্ব মুসলিম সমাজে দিনটি পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) নামে পরিচিত। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা একে অফুরন্ত পুণ্যময় ও বরকতময় দিন হিসেবে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন।

banner

আরবের সমাজ যখন পৌত্তলিকতা, কুসংস্কার ও নৈতিক অবক্ষয়ের অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল, তখন মানবতার মুক্তির দূত হিসেবে মহান আল্লাহ প্রেরণ করেছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে, যিনি সমগ্র জগতের জন্য রহমত ও দিশারী হয়ে আবির্ভূত হন।

এই দিনে মুসলমানরা নফল রোজা পালন করেন, দরুদ শরীফ পাঠ করেন, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করেন এবং দান-খয়রাতসহ নানাবিধ নেক আমল ও নফল ইবাদতে মশগুল থাকেন। তাঁদের বিশ্বাস—এই সব ইবাদত ও সৎকর্মের মাধ্যমে নবীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায়।

পবিত্র কুরআন মাজিদের আলোকে নবীর আগমন :

আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন—

“বলুন, আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়ার কারণে তারা আনন্দ করুক। এটা তাদের জমা করা সব ধনসম্পদের চেয়ে উত্তম।”

(সূরা ইউনুস, ১০:৫৮)

এই আয়াত প্রমাণ করে—আল্লাহর সবচেয়ে বড় রহমত ও অনুগ্রহ হলো নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আগমন। তাঁর জন্মে আনন্দ করা তাই ঈমানদারের স্বাভাবিক কর্তব্য।

আরেক আয়াতে বলা হয়েছে—

“আমি আপনাকে (হে নবী) সমগ্র জগতের জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি।”

(সূরা আম্বিয়া, ২১:১০৭)

তাই, নবীর জন্ম মানেই দুনিয়ায় রহমতের সূচনা, অন্ধকারে আলোর বিস্তার, মানবতার মুক্তি।

হাদিসের দলিল:  প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই তাঁর জন্মদিন স্মরণ করেছেন।

হযরত আবু কাতাদা (রা.) বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সোমবারে রোজা রাখতেন। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন—

“এ দিনেই আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং এ দিনেই আমার উপর প্রথম ওয়াহি নাযিল হয়েছে।”

(সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১১৬২)

এ থেকে প্রমাণিত হয়—নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জন্মদিনে শুকরিয়া আদায় করেছেন। তাঁর উম্মত যদি একই দিনে কুরআন তিলাওয়াত, দরুদ পাঠ, সীরাত আলোচনা ও আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে, তবে তা সুন্নাহসম্মত এবং পূণ্যময়।

ইসলামি আলেমদের দৃষ্টিতে:

শীর্ষস্থানীয় ইসলামি আলেমরা ঈদে মিলাদুন্নবীর গুরুত্ব স্বীকার করেছেন।

আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) বলেন:

“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মদিনে আনন্দ প্রকাশ করা ও মিলাদ মাহফিল করা মুস্তাহাব।”

ইমাম জালালউদ্দীন সিউতী (রহ.) লিখেছেন:

“মিলাদুন্নবী মাহফিলে অংশগ্রহণ করা, নবীর জন্মের মাহাত্ম্য বর্ণনা করা এবং তাঁর উপর দরুদ পাঠ করা কল্যাণকর কাজ।”

মিলাদ উদযাপনের উদ্দেশ্য:

ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোনো বিলাসিতা বা অপচয়ের উৎসব নয়। এর মূল উদ্দেশ্য হলো—

শোকরিয়া প্রকাশ: নবীর জন্মের জন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন।

সীরাত শিক্ষা: নবীর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে আমল করা।

দরুদ জিকির: নবীর প্রতি ভালোবাসা ও সংযোগ বৃদ্ধি করা।

ঐক্য প্রতিষ্ঠা: উম্মাহকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করা।

সামাজিক কল্যাণ: দরিদ্র ও অভাবীদের সহায়তা করা।

আজকের প্রেক্ষাপটে শিক্ষা:

আজকের পৃথিবী বিভক্ত, অশান্ত ও স্বার্থান্ধ। ঈদে মিলাদুন্নবী আমাদের শেখায়—

করুণা, দয়া, সততা, ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসা ছাড়া শান্তি আসবে না।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর জীবনই প্রকৃত মানবতার আদর্শ।

তাঁর শিক্ষা অনুসরণ করলেই দুনিয়া ও আখেরাতে মুক্তি সম্ভব।

এই দিনে শুধু আনুষ্ঠানিক শোভাযাত্রা নয়, বরং আত্মবিশ্লেষণ, ইবাদত ও মানবতার সেবাই হওয়া উচিত মূল উদ্দেশ্য।

উপসংহার:

পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী আমাদের জন্য কেবল একটি স্মরণোৎসব নয়, বরং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা, নবীর প্রতি ভালোবাসা এবং ইসলামের চেতনা পুনর্জাগরণের দিন। কুরআন, সহিহ হাদিস এবং আলেমদের ঐক্যমত প্রমাণ করে—এই দিনটি আনন্দ, কুরআন তিলাওয়াত, দরুদ ও সীরাত আলোচনা দিয়ে পালন করা একটি সওয়াবের কাজ।

তাই আসুন, আমরা প্রিয় নবীর জন্মদিনে তাঁর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করি, তাঁর সুন্নাহকে জীবনে ধারণ করি এবং আল্লাহর রহমতের বার্তা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিই।

 

।।চলমান।।

 

লেখক : স্বচ্ছ আজিজি, লেখক ও গবেষক, বাল্টিমোর, মেরিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র থেকে। 

ঈদে মিলাদুন্নবী বিশেষ সংখ্যা ২০২৫

এই সম্পর্কিত আরো পোস্ট দেখতে পারেন

কমেন্ট লিখুন