তৃণমূলের সংবাদ ডেস্ক:
মানবজাতির চিকিৎসা ইতিহাসে ভেষজ উপাদানের গুরুত্ব চিরকালীন। তবে কিছু ভেষজ এমন আছে, যেগুলোকে শুধু অভিজ্ঞতা নয়, আধ্যাত্মিক বাণীও বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। কালিজিরা বা হাব্বাতুস সৌদা তার মধ্যে অন্যতম। চৌদ্দ শ বছর আগে মহানবী (সা.) এটিকে ঘোষণা করেছিলেন মৃত্যু ব্যতীত সব রোগের আরোগ্যের উপায়।
আজ আধুনিক বিজ্ঞানও প্রমাণ করছে, কালিজিরার ক্ষুদ্র দানার ভেতরে লুকিয়ে আছে অসংখ্য রোগ নিরাময়ের শক্তি।
عَنْ خَالِدِ بْنِ سَعْدٍ قَالَ خَرَجْنَا وَمَعَنَا غَالِبُ بْنُ أَبْجَرَ فَمَرِضَ فِي الطَّرِيقِ فَقَدِمْنَا الْمَدِينَةَ وَهُوَ مَرِيضٌ فَعَادَهُ ابْنُ أَبِي عَتِيقٍ فَقَالَ لَنَا عَلَيْكُمْ بِهٰذِهِ الْحُبَيْبَةِ السَّوْدَاءِ فَخُذُوا مِنْهَا خَمْسًا أَوْ سَبْعًا فَاسْحَقُوهَا ثُمَّ اقْطُرُوهَا فِي أَنْفِه„ بِقَطَرَاتِ زَيْتٍ فِي هٰذَا الْجَانِبِ وَفِي هٰذَا الْجَانِبِ فَإِنَّ عَائِشَةَ حَدَّثَتْنِي أَنَّهَا سَمِعَتْ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلميَقُوْلُ إِنَّ هٰذِهِ الْحَبَّةَ السَّوْدَاءَ شِفَاءٌ مِنْ كُلِّ دَاءٍ إِلاَّ مِنْ السَّامِ قُلْتُ وَمَا السَّامُ قَالَ الْمَوْتُ.
অনুবাদ
খালিদ ইবনে সাদ হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা (যুদ্ধের অভিযানে) বের হলাম। আমাদের সঙ্গে ছিলেন গালিব ইবনু আবজার।
তিনি পথে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এরপর আমরা মদিনায় ফিরলাম, তখনো তিনি অসুস্থ ছিলেন। তাঁকে দেখাশোনা করতে আসেন ইবনু আবু আতিক। তিনি আমাদের বললে, তোমরা এ কালিজিরা সাথে রেখো। এ ত্থেকে পাঁচটি কিংবা সাতটি দানা নিয়ে পিষে ফেলবে, তারপর তন্মধ্যে যাইতুনের কয়েক ফোঁটা তেল ঢেলে দিয়ে তার নাকের এদিক-ওদিকের ছিদ্র দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা করে প্রবিষ্ট করাবে। কেননা, আয়েশা আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন, এই কালিজিরা ‘সাম’ ছাড়া সব রোগের ওষুধ। আমি বললাম, ‘সাম’ কী? তিনি বললে, মৃত্যু। (বুখারি, হাদিস : ৫৬৮৭)
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা
কালিজিরার (হাব্বাতুস সৌদা) গুণাগুণ নিয়ে মুফাসসির ও মুহাদ্দিসদের ব্যাখ্যা
ইমাম নববী (রহ.) বলেন, কালিজিরা সব রোগের জন্য নিরাময় অর্থ এই নয় যে প্রতিটি রোগেই একে একা ব্যবহার করলে আরোগ্য আসবে। বরং কখনো সরাসরি, কখনো অন্য ওষুধের সাথে মিশিয়ে, কখনো প্রতিরোধক হিসেবে এবং কখনো শরীরের প্রতিরোধক্ষমতা জোরদারকারী উপাদান হিসেবে এটি কাজ করে।
ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আত্তিব্বুন্নববী’-তে উল্লেখ করেছেন : কালিজিরা নানা রোগের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমতস্বরূপ এক প্রকার ভেষজ। এটি শরীরকে শক্তিশালী করে, পেটের অস্বস্তি দূর করে, হজমশক্তি বাড়ায়, ঠাণ্ডা-কাশি ও শ্বাসকষ্ট কমায় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নত করে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের আলোকে কালিজিরার উপকারিতা
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানও কালিজিরার অসাধারণ উপকারিতা প্রমাণ করেছে। বৈজ্ঞানিকভাবে একে বলা হয় Nigella sativa। এর বীজে যে প্রধান সক্রিয় উপাদান রয়েছে তার নাম Thymoquinone (থাইমোকুইনন)।
প্রমাণিত বৈজ্ঞানিক উপকারিতা
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি (Immunomodulatory effect) : কালিজিরা শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, এটি শ্বেত রক্তকণিকার কার্যকারিতা বাড়ায় এবং সংক্রমণের ঝুঁকি কমায়।
অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের প্রভাব : কালিজিরা কোষকে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস থেকে রক্ষা করে, ফলে বার্ধক্য বিলম্বিত হয় এবং ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিভাইরাল : গবেষণায় প্রমাণিত যে এটি ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসবিরোধী ক্ষমতা রাখে। তাই বিভিন্ন সংক্রমণজনিত রোগে এটি কার্যকর হতে পারে।
শ্বাসযন্ত্রের রোগে উপকার : হাঁপানি, কাশি, ব্রংকাইটিসে কালিজিরা উপকারী প্রমাণিত। আধুনিক রিসার্চে দেখা গেছে যে এটি ফুসফুসের প্রদাহ কমায়।
ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে সহায়ক : এটি রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
কোলেস্টেরল কমায় এবং হৃদযন্ত্রকে সুরক্ষা দেয়।
পরিপাকতন্ত্রের রোগে উপকার : পেটের গ্যাস, বদহজম, ডায়রিয়া, আলসার ইত্যাদিতে কালিজিরা ব্যবহারে উপকার মেলে।
হাদিস ও বিজ্ঞানের মিল
হাদিসে যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, ‘কালিজিরা মৃত্যু ছাড়া সব রোগের চিকিৎসা’ এটি মূলত এর ব্যাপক ভেষজ উপকারিতা বোঝানোর জন্য। অর্থাৎ আল্লাহ কালিজিরাকে এমন গুণ দিয়েছেন যে উপযুক্ত ব্যবহার করলে বহু রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করা যায়। আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কার এই সত্যকে শক্তভাবে সমর্থন করেছে।
তবে মৃত্যু (সাম) অনিবার্য। পৃথিবীর কোনো ওষুধই মৃত্যুকে প্রতিরোধ করতে পারে না।
কালিজিরা শুধু একটি ভেষজ নয়, বরং এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য এক বিশেষ নিয়ামত। সঠিক নিয়মে ব্যবহার করলে এটি বিভিন্ন রোগে আরোগ্যের উপকরণ হয়ে থাকে। তবে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলেন, এটি যেন কখনোই মূল চিকিৎসার বিকল্প না হয়; বরং চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে সহযোগী চিকিৎসা হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।