তিন দফা দাবি আদায়ে আন্দোলনরত প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। বুধবার ছাত্ররা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুশিল বাধা দেয়। এরপর শুরু হয় সংঘর্ষ। রাজধানীর শাহবাগ থেকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, যমুনার সামনে গোল আইল্যান্ড এবং পরিবাগ মোড় পর্যন্ত দুপক্ষের সংঘর্ষে কার্যত রণক্ষেত্রে রূপ নেয়। পুলিশ শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে তাদের ওপর বেধড়ক লাঠিচার্জ করে। এ সময় দফায় দফায় টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। ব্যবহার হয় জলকামান। এতে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা একপর্যায়ে পুলিশের ওপর চড়াও হন। তারা পুলিশের প্রতি ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন। এতে অর্ধতাধিক শিক্ষার্থীসহ বেশকিছু পুলিশ সদস্যও আহত হন। আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসা দেওয়া হয়। আন্দোলনকারীদের দাবির যৌক্তিকতা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সরকার ৮ সদস্যের কমিটি গঠন করে। কিন্তু এতে শিক্ষক ও ছাত্রদের কোনো প্রতিনিধি না থাকায় কমিটি প্রত্যাখ্যান করেন আন্দোলনকারীরা। তারা বিকালে তিন দফার পরিবর্তে ৫ দফা দাবি তুলে ধরেন। এসব দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত রাজপথে অবস্থানের ঘোষণা দেন। তবে রাত ১১টার দিকে আজ থেকে দেশের সব প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে শাহবাগ ত্যাগ করেন শিক্ষার্থীরা। আজকের মধ্যে দাবি আদায় না হলে আরও নতুন কর্মসূচি দেওয়া হবে বলে তারা জানান। জনদুর্ভোগ এড়াতে আজ শাহবাগ অবরোধ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। ঢাকায় প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশি হামলার প্রতিবাদ জানিয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এদিকে দুপুরে কাকরাইলে আন্দোলনরত ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ করে। প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী।
সন্ধ্যা সোয়া ৭টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের সঙ্গে বৈঠক করে আন্দোলনকারীদের ১১ সদস্যের প্রতিনিধিদল। তবে বৈঠকে কোনো অগ্রগতি হয়নি। শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, আজ বিকালে আবারও সরকারের সঙ্গে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। বৈঠক শেষে উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান সাংবাদিকদের বলেন, প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা অনাকাঙ্ক্ষিত। আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এর আগে সন্ধ্যায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে শাহবাগে আসেন বুয়েট উপাচার্য অধ্যাপক আবু বোরহান মোহাম্মদ বদরুজ্জামান। তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের ওপর হামলার বিচার ও যৌক্তিক দাবি মেনে নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান। আন্দোলন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের ঘরে ফেরার অনুরোধ করেন তিনি। উপাচার্য তাদের বলেন, আন্দোলনকারী প্রতিনিধিদলের সঙ্গে কথা বলতে দুই উপদেষ্টা রেল ভবনে অপেক্ষা করছেন। এরপর ১১ জন ছাত্র প্রতিনিধি সেখানে যান।
আন্দোলনরত প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলার প্রতিবাদ জানিয়েছে বুয়েট।
বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আন্দোলনকারীরা তৃতীয় দিনের মতো শাহবাগ মোড়ে এসে অবস্থান নেন। পূর্বঘোষিত লংমার্চ টু ঢাকা কর্মসূচির অংশ হিসাবে বুধবার বেলা ১১টার দিকে বুয়েট এলাকায় মিলিত হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রকৌশল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এরপর তারা মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি হয়ে শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেন। এ সময় আটকে দেওয়া হয় চারপাশের সড়ক। তারা দাবির পক্ষে স্লোগান দিতে থাকেন। প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের অবস্থানের কারণে বেলা ১১টা থেকে শাহবাগ-টিএসসি, কাওরান বাজার ও বাংলামোটর পর্যন্ত যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিভিন্ন সড়কে তীব্র যানজটে গলদঘর্ম হন বৃদ্ধ, নারী, শিশুসহ সাধারণ মানুষ। ভোগান্তিতে পড়েন বিভিন্ন মেডিকেলে চিকিৎসার জন্য আগত রোগী ও তাদের স্বজনরাও। রাত ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত শাহবাগের চারপাশের সড়ক বন্ধ ছিল।
শিক্ষার্থীদের শান্ত রাখার জন্য সরকার কমিটি গঠনসহ নানাভাবে চেষ্টা চালায়। সচিবালয়ে উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, আদিলুর রহমান খান ও সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তারা জানান, প্রকৌশল পেশায় বিএসসি ডিগ্রিধারী ও ডিপ্লোমাধারীদের পেশাগত দাবির যৌক্তিকতা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সুপারিশ প্রণয়নে একটি কমিঠি গঠন করেছে সরকার। কিন্তু শিক্ষার্থীরা সেই কমিটি প্রত্যাখ্যান করেন। এছাড়া জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমানও সাংবাদিকদের সঙ্গে এ প্রসঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানান, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তাদের দাবি-দাওয়ার প্রস্তাব দিলে সচিব কমিটি সমস্যার সমাধান করে দেবে।
এদিকে শিক্ষার্থীরা দুপুর ১টার মধ্যে তাদের তিন দফা দাবি মেনে প্রজ্ঞাপন জারির জন্য সরকারকে আলটিমেটাম দেন। না হলে সচিবালয় ঘেরাওয়ের হুমকি দেন তারা। কিন্তু দুপুর ১টার কিছু সময় পর আন্দোলনকারীরা সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি থেকে সরে এসে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা ঘেরাওয়ের কর্মসূচি ঘোষণা দেন এবং দুপুর দেড়টার দিকে শাহবাগ থেকে যমুনা অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। তারা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড় থেকে যমুনার সামনে গোল ট্রাফিক আইল্যান্ডের কাছাকাছি পৌঁছালে পুলিশ বাধা দেয়। একপর্যায়ে ব্যারিকেড ভেঙে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু হয়। পুলিশ প্রথমে জলকামান ব্যবহার করে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা পিছু না হটায় একের পর এক সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়া হয়। চারপাশ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এ সময় গোটা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা। ব্যাপক লাঠিচার্জ করে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে পুলিশ। একপর্যায়ে পিছু হটে শিক্ষার্থীরা আবারও সংঘবদ্ধ হয়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান। পুলিশ জলকামান নিক্ষেপ করলে আন্দোলনকারীরা পালটা ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। প্রায় ১ ঘণ্টা দুপক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পালটাধাওয়া চলে। সংঘর্ষে শিক্ষার্থীদের অনেকেই আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পুলিশের কাঁদানে গ্যাসে চারপাশ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। অনেককে সড়কের পাশে পড়ে থাকতে দেখা যায়। শিক্ষার্থীরা রাস্তায় শুয়ে-বসে স্লোগান দিতে থাকেন। তারা পুলিশের বাধায় শাহবাগ মোড়ে ফিরে আসেন। তবে বেলা ৩টার দিকে আবারও হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে চলে আসেন। এখানে পুলিশ ও শিক্ষার্থীরা মুখোমুখি অবস্থান নেয়। এখানে বসে পড়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। তারা বলেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ ছাড়ব না।
বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাইয়াজ বলেন, পুলিশের হামলায় আমাদের অনেকে গুরুতর আহত হয়েছে। বিভিন্ন হাসপাতালে তাদের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। তবুও দাবি না মানা পর্যন্ত আমরা সড়ক ছাড়ব না। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, পুলিশ শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অকারণে হামলা চালিয়েছে। তাদের ওপর বেধড়ক লাঠিপেটা করা হয়েছে। টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে আতঙ্ক তৈরি করা হয়েছে। যারা এসবের নির্দেশ দিয়েছে, তাদের অবিলম্বে বহিষ্কার ও গ্রেফতার করতে হবে। আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাইম মির্জা বলেন, মিছিলের সামনে ছিলাম। হঠাৎ বিকট শব্দ হলো, তারপর দেখি কিছু একটা এসে আমার বাঁ পায়ে আঘাত করল। ব্যথায় দাঁড়াতে পারছি না।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলম বলেন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা চলছিল। সচিবালয়ে তিনজন উপদেষ্টা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন। তাদের বলা হয়েছিল শাহবাগে অবস্থান করতে। আধা ঘণ্টার ভেতরে সমাধান হবে। কিন্তু তারা আকস্মিকভাবে যমুনার দিকে রওয়ানা দেন এবং পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করেন। তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। তিনি আরও দাবি করেন, শিক্ষার্থীরা পুলিশের ওপর ইটপাটকেল ছোড়ে, এতে কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খালিদ মনসুর জানান, যমুনা ও আশপাশ এলাকায় আগে থেকেই ১৪৪ ধারা জারি আছে। যে কারণে ওই এলাকা থেকে ধাওয়া দিয়ে আন্দোলনকারীদের শাহবাগে নিয়ে গেছে পুলিশ।
দুই উপদেষ্টার সঙ্গে প্রকৌশল শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের বৈঠক : প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল উল্লেখ করে দুঃখ প্রকাশ করেছেন রেলপথ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। বুধবার সন্ধ্যায় প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বৈঠক শেষে একথা বলেন তিনি।
এর আগে সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ রাজধানীর রেলভবনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বৈঠক শুরু হয়। প্রায় ১ ঘণ্টার বৈঠক শেষ হয় কোনো সমাধান ছাড়াই। এসময় পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
উপদেষ্টা ফাওজুল কবির বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবি চাকরি বা নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে আরও যেসব অংশীজন রয়েছে-তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আগামীকাল (আজ) আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তিনি বলেন, দাবি-দাওয়া, আলোচনা সবকিছু হবে। কিন্তু কথায় কথায় শাহবাগ অবরোধ ও যমুনায় যাওয়া এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ছাত্রদের জন্য আমাদের দরজা খোলা। তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ অব্যাহত থাকবে।
সব প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ : দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আজ বৃহস্পতিবার থেকে দেশের সব প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছেন প্রকৌশল শিক্ষার্থীরা। বুধবার শিক্ষার্থীদের পক্ষে প্রকৌশলী অধিকার আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক সাকিবুল হক লিপু এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
তিনি বলেন, আগামীকাল (আজ ) দেশের সব প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস-পরীক্ষা সব বন্ধ থাকবে। দাবি আদায় না হলে বৃহস্পতিবার বিকালে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। এ সময় তিনি জনদুর্ভোগ হয় এমন কর্মসূচি এড়িয়ে যাওয়ার কথা জানান। তিনি বলেন, আমাদের ৩ দফা দাবির কোনোটাই পূরণ হয়নি। পলিসি মেকার যারা বসে আছেন-তারা কেউ আমাদের আন্দোলনের বিষয় সম্পর্কে কিছুই জানেন না। এ সময় চার উপদেষ্টা ও ইঞ্জিনিয়ারদের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটিতে শিক্ষার্থীদের মনোনীত সদস্য যোগ দেবে বলেও জানান তিনি।
শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় ডিএমপি কমিশনারের দুঃখ প্রকাশ : শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ এবং লাঠিচার্জের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী। বুধবার রাত সোয়া ১০টার দিকে শাহবাগ মোড়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত সংলাপের পর তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলাকে অপ্রীতিকর ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এজন্য আমি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার হিসাবে দুঃখিত এবং দুঃখ প্রকাশ করছি। এ ঘটনার তদন্তের জন্য আগামীকাল (আজ) একটি কমিটি গঠন করা হবে।
সরকারের কমিটি : প্রকৌশল পেশায় বিএসসি ডিগ্রিধারী ও ডিপ্লোমাধারীদের পেশাগত দাবির যৌক্তিকতা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সুপারিশ প্রণয়নে একটি কমিঠি গঠন করেছে সরকার। বুধবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় ও সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানকে কমিটির সভাপতি করা হয়। এছাড়া শিল্প মন্ত্রণালয় ও গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, প্রকৌশলী মোহাম্মদ রেজাউল ইসলাম, প্রকৌশলী মো. কবির হোসেন, প্রকৌশলী তানভীর মঞ্জুর ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক এ কমিটিতে রয়েছেন। কমিটিকে এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বুধবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, এই আন্দোলনের সূত্রপাত হয় নেসকোর (নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি) একটা ঘটনা (একজন প্রকৌশলীকে হত্যার হুমকি) থেকে। সেই ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। জড়িতদের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন। শাস্তিমূলক বদলিও করা হয়েছে। উপদেষ্টা বলেন, দাবি দুদিক থেকে-বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারদের দাবি এক রকম, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের দাবি ভিন্ন। সব পক্ষের কথা শুনে ন্যায্য যে সমাধান-সেটাই আমরা করব।
কমিটি প্রত্যাখ্যান, নতুন ৫ দাবি : সরকারের এই কমিটিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন আন্দোলনকারীরা। তারা বলছেন, তাদের দাবি বাস্তবায়নে সময়ক্ষেপণ নয়, তাৎক্ষণিক নির্বাহী আদেশ দিতে হবে। বুধবার বিকালে রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি জুবায়ের আহমেদ বলেন, প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে গঠিত কমিটিতে আমাদের প্রতিনিধি অনুপস্থিত থাকায় আমরা সেটি প্রত্যাখ্যান করলাম। এ সময় তিনি পাঁচটি দাবি ঘোষণা করেন। সেগুলো হলো-প্রকৌশল অধিকার আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে আন্দোলনকারীদের সামনে এসে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে এবং জবাবদিহি করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রতিনিধিসহ প্রকৌশল অধিকার আন্দোলনের স্টেকহোল্ডারদের অন্তর্ভুক্ত করে কমিটি অবিলম্বে সংস্কার করতে হবে। আগেই পেশ করা তিন দফা দাবি দ্রুততম সময়ে মেনে নিয়ে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে।
যে তিন দফা নিয়ে আন্দোলন শুরু : ১. সহকারী প্রকৌশলী (নবম গ্রেড) পদে নিয়োগ : শুধু ন্যূনতম বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রিধারীদের নিয়োগ দিতে হবে। কোনোভাবেই কোটাভিত্তিক বা অন্য নামে নতুন পদ সৃষ্টি করে পদোন্নতির সুযোগ দেওয়া যাবে না। ২. উপসহকারী প্রকৌশলী (দশম গ্রেড) পদে নিয়োগ : ন্যূনতম ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার এবং একই ডিসিপ্লিনে উচ্চতর ডিগ্রিধারী বিএসসি গ্র্যাজুয়েটদের জন্য নিয়োগ পরীক্ষার সুযোগ রাখতে হবে। ৩. প্রকৌশলী পদবির সুরক্ষা : বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি ছাড়া কেউ প্রকৌশলী পদবি ব্যবহার করতে পারবেন না-এর জন্য আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি নন-অ্যাক্রিডেটেড বিএসসি কোর্সগুলোকে দ্রুত আইইবি-বিএইটিইর স্বীকৃতির আওতায় আনতে হবে।
কাকরাইলে আন্দোলনকারী ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের পুলিশের লাঠিচার্জ : বাংলাদেশ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র-শিক্ষক পেশাজীবী সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে অংশ নেওয়া আন্দোলনকারীদের লাঠিচার্জ করেছে পুলিশ। বুধবার দুপুরে রাজধানীর কাকরাইলের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনের রাস্তায় লাঠিচার্জ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়। আন্দোলনকারী ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র-শিক্ষক-পেশাজীবী সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক মো. আখেরুজ্জামান জানান, ৭ দফা দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার কর্মসূচি ছিল তাদের। দুপুর ১২টায় তারা কাকরাইলের ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (আইডিইবি) থেকে কর্মসূচি শুরু করেন। এতে অনেক ডিপ্লোমা শিক্ষার্থী, প্রকৌশলী ও পেশাজীবী অংশ নেন। তারা মিছিল নিয়ে মগবাজার মোড়ে পৌঁছালে পুলিশ বাধা দেয়। পরে সংগ্রাম পরিষদের ১১ জন প্রতিনিধি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে গিয়ে স্মারকলিপি জমা দেন।
যানজট দুর্ভোগ : এদিকে আন্দোলন চলাকালে দিনভর যানজটের ভোগান্তিতে পড়েন রোগী, তাদের স্বজনসহ, চাকরিজীবী ও বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ। সরেজমিন দেখা গেছে, কাওরানবাজারের দিক থেকে আসা যানবাহনকে বাংলামোটর হয়ে মগবাজারের দিকে যেতে দেওয়া হচ্ছে। মৎস্য ভবন হয়ে শাহবাগ দিয়ে বিভিন্ন গন্তব্যে যেসব বাস চলাচল করে, সেগুলো শাহবাগ মোড়ে এসে ফিরে যাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে যেসব যানবাহন শাহবাগ হয়ে বিভিন্ন গন্তব্যে যায়, সেসব যানবাহনকে শাহবাগ মোড় পার হতে দেওয়া হয়নি। কাঁটাবন মোড় হয়ে শাহবাগের দিকে আসা গাড়িগুলো রাস্তায় আটকে থাকতে দেখা যায়। তবে রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্সগুলোকে রাস্তা ছেড়ে দিতে দেখা গেছে আন্দোলনকারীদের। রোগীদের যারা প্রাইভেট কিংবা পাবলিক পরিবহণে এসেছিলেন, তারা চরম দুর্ভোগে পড়েন। রাত ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সড়ক বন্ধ রেখে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন শিক্ষার্থীরা।
চট্টগ্রামে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে ‘অন্তর্বর্তী সরকারের গায়েবানা জানাজা’ : চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ (চুয়েট) বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থীরা। বুধবার বিকাল ৫টায় নগরীর ২ নম্বর গেটে এই আন্দোলন করেন তারা। এতে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ শতাধিক শিক্ষার্থী অংশ নেন। এ সময় ঢাকায় প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলার প্রতিবাদ জানানো হয়। সন্ধ্যায় তারা সড়কে দাঁড়িয়েই ‘অন্তর্বর্তী সরকারের গায়েবানা জানাজা’ পড়েন। প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানায়, শিক্ষার্থীরা সড়কে অবস্থান করায় নগরীর ব্যস্ততম মোড় ২ নম্বর গেট এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। এতে দুই পাশের সড়কে কয়েকশ যানবাহন আটকে পড়ে। এর প্রভাবে নগরীর জিইসি, মুরাদপুর, অক্সিজেন, চকবাজার ও মেডিকেল সংযোগ সড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়।
রুয়েট শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ : রাবি প্রতিনিধি জানান, ঢাকায় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে রাজশাহীতে সড়ক অবরোধ করেছেন রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (রুয়েট) শিক্ষার্থীরা। বুধবার বেলা ৩টার দিকে নগরের তালাইমারী মোড়ে রাজশাহী শহরের অন্যতম প্রবেশপথ তারা অবরোধ করেন। এতে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রী ও পরিবহণ শ্রমিকরা।
“সুত্র: দৈনিক যুগান্তর”