Home » যিনি প্রশাসক তিনিই গবেষক আবার শিক্ষকও

যিনি প্রশাসক তিনিই গবেষক আবার শিক্ষকও

0 মন্তব্য গুলি 6 জন দেখেছে 6 মিনিট পড়েছেন

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) যিনি প্রশাসক, তিনিই গবেষক। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানকারী শিক্ষকও তিনি। একই সঙ্গে একই ব্যক্তি তিন কিসিমের কাজ করায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। গবেষণা এবং প্রশাসনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও তারা কোনোটিই বাদ দিতে চান না।

উপাচার্য পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় পছন্দের লোকদের পদ। সবচেয়ে লাভজনক ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আসেন উপাচার্যের সবচেয়ে কাছের ব্যক্তি। যাকে তিনি ‘অন্ধ বিশ্বাস’ করতে পারেন। তারা কখনো হন ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জনসংযোগ প্রশাসক, কখনো ছাত্র উপদেষ্টা। তারা গবেষণায় সর্বোচ্চ বরাদ্দ পান। প্রশাসক হয়ে করবেন প্রশাসনিক কাজ, আবার প্রশাসন থেকেই সর্বোচ্চ বরাদ্দ পেয়ে করবেন গবেষণা। নেবেন ক্লাস-পরীক্ষাও।

সম্প্রতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাত থেকে ১ কোটি ৪৩ লাখ ৫৬ হাজার ৪০০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকদের। এসব বরাদ্দে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যারা প্রশাসনিক ও অ্যাকাডেমিকভাবে উপাচার্যের ঘনিষ্ঠ, তাদের অনেকেই হয়েছেন বরাদ্দপ্রাপ্ত। যদিও উপাচার্য বলছেন, ‘আমি চাইলে এটা যাকে ইচ্ছা দিতে পারতাম। তবে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য আমি তা করিনি।’

বরাদ্দ পাওয়া ওই শিক্ষকদের তালিকা থেকে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৩ জন শিক্ষক এই বরাদ্দ পেয়েছেন। এর মধ্যে প্রশাসক, পরিচালক, প্রভোস্ট, সহকারী প্রক্টরসহ প্রশাসনের আছেন ৯ জন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান (অর্থনীতি বিভাগ) ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুন্সী ইসরাইল হোসেন ৮ লাখ টাকা করে বরাদ্দ পেয়েছেন। রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ইফতিখারুল আলম মাসউদ (আরবি বিভাগ) পেয়েছেন ৫ লাখ টাকা। জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক অধ্যাপক আখতার হোসেন মজুমদার (সমাজকর্ম বিভাগ) ও অধ্যাপক সাঈদ আখতার পেয়েছেন ৬ লাখ টাকা। ছাত্র উপদেষ্টা সহযোগী অধ্যাপক আমিরুল ইসলাম (ফোকলোর বিভাগ) পেয়েছেন ৫ লাখ টাকা। ক্যারিয়ার কাউন্সিলিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক নূরুল মোমেন (লোকপ্রশাসন বিভাগ) পেয়েছেন ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা।

banner

নবাব আব্দুল লতিফ হলের প্রাধ্যক্ষ (ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ) অধ্যাপক আতাউল্যাহ পেয়েছেন ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর অধ্যাপক নাসির উদ্দিন (উর্দু বিভাগ) ও অধ্যাপক মুহাম্মাদ শহীদুল ইসলাম পেয়েছেন ৫ লাখ টাকা। ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের (আইবিএস) পরিচালক অধ্যাপক এম. মোস্তফা কামাল পেয়েছেন ৯ লাখ টাকা। আইবিএর পরিচালক অধ্যাপক শরিফুল ইসলাম পেয়েছে ৫ লাখ টাকা।

উপাচার্যের বিভাগ (পদার্থবিজ্ঞান) থেকে পেয়েছেন সর্বোচ্চ ছয়জন। যার মধ্যে সদ্য নিয়োগ পাওয়া তিন শিক্ষকও পেয়েছেন ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ। সদ্য নিয়োগ পাওয়া তিনজন হলেন লেকচারার নাজির আহমেদ, ইহতিসাম কাবিদ ও আসিফ আফজাল। তারা সম্মিলিত এক গবেষণার জন্য বরাদ্দ পেয়েছেন এই টাকা। বিভাগের অন্য তিন শিক্ষক হলেন অধ্যাপক ছামিউল ইসলাম সরকার ৬ লাখ ও অধ্যাপক আতিকুর রহমান পাটোয়ারী ও অধ্যাপক আবুল কালাম ফজলুল হক পেয়েছেন ৮ লাখ টাকা করে।

এ ছাড়া গবেষণার জন্য বরাদ্দ পেয়েছেন যারা হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থা বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ জাবিদ হোসাইন ৫ লাখ, রসায়ন বিভাগের রবিউল করিম ৮ লাখ, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক জাকের হোসাইন ৬ লাখ, ফলিত রসায়ন ও রসায়ন প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামীম আহসান ৮ লাখ, ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফয়েজ আহমেদ ৫ লাখ, ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক এএইচএম খুরশীদ আলম ও অধ্যাপক আজিজ আব্দুর রহমান ৭ লাখ, ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক এএইচএম জিয়াউল হক ও আমজাদ হোসেন ৫ লাখ, দর্শন বিভাগের অধ্যাপক আরিফুল ইসলাম ৪ লাখ ১০ হাজার, আইন বিভাগের অধ্যাপক বেগম আসমা সিদ্দীকা ও অধ্যাপক সাঈদা আঞ্জু ৫ লাখ করে, পরিবেশবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা ৯ লাখ ৮১ হাজার ৪০০, মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক একেএম গোলাম রব্বানী ম-ল ৫ লাখ, ফলিত রসায়ন ও রসায়ন প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ছাইফুল ইসলাম ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা।

তাদের মধ্যে জুলাই নিয়ে দুটি গবেষণায় মোট তিনজন শিক্ষক প্রায় ১৫ লাখ বরাদ্দ পেয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক গবেষণা করবেন ‘২০২৪ সালের জুলাই মাসের অস্থিরতার পেছনের প্রভাব’ নিয়ে এবং আইবিএসের পরিচালক অধ্যাপক এম. মোস্তফা কামাল ‘জুলাইয়ে রাজশাহী নগরের আন্দোলন ও ব্যাপ্তি বিশ্লেষণ’ নিয়ে।

বরাদ্দ পাওয়া উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান বলেন, ‘এখানে যারা প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করছেন তারা শিক্ষক, তারা গবেষকও। সুতরাং তারা গবেষণা করবেন এটাই তো স্বাভাবিক। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, প্রশাসন এত ফান্ড কীভাবে পেল? প্রথম কথা এটা উপাচার্যের ডিসক্রিশনারি ফান্ড। উনি দায়িত্বে আসার পর হিসাব দপ্তর থেকে জানানো হয়, গবেষণার জন্য একটা বরাদ্দ আছে। এটা জুনের মধ্যে যদি না দেওয়া হয় তাহলে ইউজিসিতে ফেরত যাবে। তখন উপাচার্যের কাছের যারা আছেন, তাদের বললেন যারা ভালো রিসার্চার আছে তাদের কাছে থেকে প্রপোজাল আশা করছি। খুব কম সময় ছিল তাই পাবলিকলি এটা জানানো হয়নি।’ ‘আপনি কীভাবে পেলেন’ এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সমাজবিজ্ঞান অনুষদের এক শিক্ষক বরাদ্দ পেয়েছেন। তিনি কো-অর্ডিনেটর। আমি ওই টিমের সদস্য একজন।’

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছর যে গবেষণা বরাদ্দগুলো আসে এর একটা বড় অংশ প্রত্যেকটা অনুষদ ও ইনস্টিটিউটে দিয়ে দেওয়া হয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা অনুসারে অনুষদ থেকে প্রপোজাল চাওয়া হয় শিক্ষকদের কাছে। সেটা যাচাই-বাছাই করে শিক্ষকদের একটা বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেটা একক হলে ২ লাখ এবং যৌথ হলে ৪ লাখ। এর বাইরে উপাচার্যের ‘ডিসক্রিশনারি’ একটা ফান্ড থাকে, যা তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো গবেষককে দিতে পারেন। বিগত উপাচার্য তার ইচ্ছামতো কয়েকজনকে এই বরাদ্দ দিতেন। কাউকে খুব বেশি দিতেন আবার কাউকে খুব কম। তবে এবার উপাচার্য নির্দিষ্ট একটা মার্জিন ঠিক করে গবেষণার জন্য এ বরাদ্দ দিয়েছেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগে ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, এখন হয়েছে জুলাই-আগস্টের চেতনা। এই চেতনাকে বিক্রি করে আমরা ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করছি। নতুন বাংলাদেশে এ প্রজন্মকে সঙ্গে নিয়ে যে স্বপ্ন বা দেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলাম তার সঙ্গে বর্তমান প্রশাসনের সে কার্যক্রম সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। এ বরাদ্দে উপাচার্যের ঘনিষ্ঠজন ও একটি রাজনৈতিক সংগঠনের শিক্ষকদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। গবেষকদের র‌্যাংকিং অনুযায়ী যে শিক্ষকরা এগিয়ে আছেন, তারা কেন এই বরাদ্দ পেলেন না?’

তিনি আরও বলেন, ‘যাদের এ গবেষণা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে উপাচার্যের কাছের কিছু প্রশাসনিক ব্যক্তি আছেন। তারা কি প্রশাসনিক কাজ করবেন না গবেষণা করবেন? না তারা ক্লাস-পরীক্ষা নেবেন? কারণ, আমরা দেখছি যারা প্রশাসনিক কাজ করছেন, তারা ঠিকমতো ক্লাস, পরীক্ষা নিতে আসছেন না। পরীক্ষার খাতা দেখতে সময় পাচ্ছেন না। প্রশ্ন মডারেশন বোর্ডেও আসেন না। তারা কীভাবে এ গবেষণার কাজ করবেন। এখন উপাচার্য যদি আগের কথা বলেন তাহলে বলব, আগের প্রশাসন কোটি কোটি টাকা দুর্নীতি করেছে। আপনিও তাই করবেন?’

নাম প্রকাশ না করা শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রথমত উপাচার্য এই বরাদ্দ দিতে পারেন। তবে কাকে দিচ্ছেন এটা একটা বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে যে ব্যক্তিরা দায়িত্ব পালন করছেন, এখন তারাই যদি এই বরাদ্দ পান তাহলে তো বলা যায়, তারা নিজেরা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন। আবার শুনছি উপাচার্য তার বিভাগের শিক্ষকদেরও প্রাধান্য দিয়েছেন। এটাও তো সবার মাঝে প্রশ্ন তুলতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘রাবিতে যিনি উপাচার্য হন তিনি সবার আগে তার প্রশাসনিক ব্যক্তিগুলোকে পরিবর্তন করেন। অথচ এখানে অনেক পদ আছে যেগুলোতে শিক্ষকরা দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। এবার পরিবর্তন হবে এমন আশা ছিল। কিন্তু বর্তমান উপাচার্যও তার কাছের মানুষগুলোকেই দায়িত্বে নিয়েছেন এবং তাদের গবেষণার বরাদ্দ দিয়ে পুরস্কৃত করেছেন। এখন তারা আলাদিনের জিনির মতো প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করবেন, ক্লাস-পরীক্ষা নেবেন, গবেষণাও করবেন।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এটা একটা ডিসক্রিশনারি ফান্ড, যার পুরোটা উপাচার্যের হাতে ন্যস্ত। আমি চাইলে এটা যাকে ইচ্ছা দিতে পারতাম। তবে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য আমি তা করিনি। আমার দুই উপ-উপাচার্যসহ কিছু আস্থাভাজন শিক্ষককে তাদের অনুষদের প্রত্যেক শিক্ষককে জানাতে বলেছিলাম যে, এমন একটা ফান্ড আছে। তারা চাইলে গবেষণা প্রপোজাল পাঠাতে পারে। ঠিক এভাবেই আমার কাছে প্রস্তাবনাগুলো এসেছে। তারপর সেগুলো থেকে বাছাই করে আমি টাকা দিয়ে দিয়েছি। এবারই প্রথম এভাবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।’

যারা প্রশাসনে থেকে গবেষণা বরাদ্দ পেয়েছে তাদের বিষয়ে উপাচার্য বলেন, ‘তারা তাদের প্রপোজাল নিয়ে এসেছে। আপনি খেয়াল করলে দেখবেন, যারা প্রশাসনিক পদে আছেন তারা কেউ এককভাবে বরাদ্দ পাননি। তবে রেজিস্ট্রার এবং ছাত্র উপদেষ্টা এককভাবে পেয়েছেন। তাদের কিন্তু বহু আগে থেকে গবেষণার ট্র্যাক রেকর্ড রয়েছে।’

প্রশাসনের যারা এ বরাদ্দ পেয়েছেন তারা একসঙ্গে এত কাজ করবেন কীভাবে? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি এখনো অনেক শিক্ষকের তুলনায় বেশি গবেষণা করি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সমৃদ্ধ গবেষণা প্রোফাইল যাদের আমি কিন্তু তাদের মধ্যে একজন। শিক্ষকরা এটা নিয়ে প্রশ্ন তুললেই তো হবে না।’

এই সম্পর্কিত আরো পোস্ট দেখতে পারেন

কমেন্ট লিখুন