ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসনের সাড়ে ১৫ বছর ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষের কাছে দুঃসহ স্মৃতি। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালানোর আগ পর্যন্ত জেলায় অন্তত ৩৬ জন বিরোধী দল-মতের মানুষ আওয়ামী লীগের নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এ ছাড়া আহত হয়েছেন অগণিত মানুষ। বিশেষ করে রিমান্ডে নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে জামায়াত নেতার মৃত্যু রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় ক্ষতের সৃষ্টি করে।
স্থানীয় সচেতন মানুষ ও রাজনৈতিক দলের ভুক্তভোগী নেতাকর্মীরা জানান, দিনের পর দিন রাজনৈতিক মিথ্যা মামলার হুলিয়া নিয়ে বন-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে বিরোধী শিবিরের অনেক নেতাকর্মীকে। অহেতুক কারাবরণ করিয়ে রিমান্ডের নামে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে অনেককে। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সময় আলেম সমাজ ও মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ওপর নেমে আসে নির্যাতনের স্টিম রোলার।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, রাজনৈতিক সৌহার্দের অনন্য দৃষ্টান্ত ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া। তবে ২০০৯ সালের নির্বাচনে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর জেলার রাজনীতির চিত্র পাল্টে যেতে শুরু করে। নিজস্ব ফায়দা হাসিলের জন্য বিরোধীদলীয় মত দমনে লাগামহীন হয়ে পড়ে আওয়ামী ক্যাডাররা। এর সঙ্গে প্রশাসনকে দলীয়করণের মাধ্যমে ব্যবহার করা হয় জনগণের বিরুদ্ধে। সরকারের নেতিবাচক দিক নিয়ে কেউ কথা বললেই পুলিশ-প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে হামলা, মামলা, দমন, নিপীড়ন, খুন সবই যেন ছিল মামুলি ব্যাপার।
শুধু তা-ই নয়, আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে হিন্দুদের টার্গেট করে হামলা ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর চালানো হতো নিপীড়ন। যার উদাহরণ ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর নাসিরনগরের সংসদ সদস্য (এমপি) এবং তৎকালীন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী ছায়েদুল হককে রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করতে এলাকার হিন্দু বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির অভিযোগ রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতা র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর বিরুদ্ধে। আর এই ষড়যন্ত্রের জন্য সায়েদুল হক সরাসরি উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগও এনেছেন। সে সময় এ ঘটনায় জড়িত থাকায় গ্রেপ্তার করা হয় মোকতাদির চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ সহচর জেলা যুবলীগ নেতা ও হরিপুর ইউপি চেয়ারম্যান দেওয়ান আতিকুর রহমান আঁখি।
এদিকে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন ঘিরে প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি প্রার্থী খালেদ হোসেন মাহবুব শ্যামলের বাড়িঘরে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ভাঙচুর করা হয় বাড়িঘরসহ বেশ কয়েকটি গাড়ি। এ ছাড়া ২০১৭ ও ২০২১ সালে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের আবেগের স্থান জামিয়া ইউনুছিয়া মাদরাসায় হামলা, হেফাজত নেতাকর্মীদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যার ঘটনা আজও দাগ কাটে স্থানীয় বাসিন্দাদের মনে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট ফখরুজ্জামান খান বলেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত ১৫ বছরে বিএনপি, জামায়াত, হেফাজতে ইসলামসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সহস্রাধিক মামলায় লক্ষাধিক নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকশ নেতাকর্মীকে অনবরত মিথ্যা মামলায় সংযুক্ত করে বছরের পর বছর কারাগারে নিক্ষিপ্ত করা হয়। একই পরিবারের বাবা, ছেলে, ভাই, এমনকি নারীদেরও ছাড় দেওয়া হয়নি। লাখ লাখ নেতাকর্মী নিপীড়নের শিকার হয়ে আজ নিঃস্ব। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নির্দেশে এখন পর্যন্ত এক হাজারের মতো মমলা নিষ্পত্তির জন্য পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে ৩৬০টি প্রত্যাহার করা হয়েছে।
হেফাজতে ইসলামের ওপর হত্যাযজ্ঞ : নিহত ১৬, আহত শতাধিক
২০২১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড চালায় আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী প্রশাসন। নির্বিচারে ১৬ ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আহত ও পঙ্গুত্ব বরণ করেন শতাধিক। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরের সময় এ ঘটনা ঘটে। কিন্তু ভারতে মসুলিম নিধনের সঙ্গে মোদির সম্পৃক্ততার কারণে তার আগমনে আপত্তি জানান শীর্ষ আলেম-ওলামারা। পরে ২৬ মার্চ বিক্ষোভের ডাক দেন হেফাজতে ইসলামে নেতাকর্মীসহ মাদরাসাছাত্র ও তৌহিদি জনতা। এর জেরে ২৭ মার্চ আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ তাদের নেতাকর্মীরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে শহরের কান্দিপাড়ায় জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদরাসায় হামলা করে।
এ সময় মাদরাসা রক্ষায় স্থানীয় জনগণও মাঠে নেমে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পরে ২৭ ও ২৮ মার্চ পুরো জেলাজুড়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়। এ সময় আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাকর্মীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জেলার বিভিন্ন পয়েন্টে বিক্ষোভ মিছিলে নির্বিচারে গুলি ছোড়ে। এতে ১৬ জন নিহত হন। পরে তাদের লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করতে বাধ্য করা হয়। এ ঘটনায় পুরো দেশজুড়ে শোক নেমে আসে। এ বিষয়ে নিহতের পরিবার মামলা করতে চাইলেও নেয়নি পুলিশ। উল্টো জেলার বিভিন্ন থানায় আলেম-ওলামাসহ বিএনপি, জামায়াত ও ভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নামে ৫৫টি মামলা দিয়ে হয়রানি ও নির্যাতন করা হয়।
পুলিশ-ছাত্রলীগ মিলে মাদরাসায় হামলা, ছাত্রকে গুলি করে খুন
২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে ছাত্রলীগের কয়েক নেতার সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদরাসার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডা হয়। এর জেরে ছাত্রলীগ ক্যাডাররা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মাদরাসাছাত্রদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় পরিস্থিতি উত্তাল হলে পুলিশও মাদরাসাছাত্রদের ওপর আগ্রাসী হয়। এক পর্যায়ে মাদরাসাছাত্র হাফেজ মাসুদুর রহমান পুলিশের গুলিতে নিহত হন।
বিএনপির এমপি প্রার্থীর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, নিহত ১
এদিকে ২০১৮ সালের নির্বাচন ঘিরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বেপরোয়া হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগ। এর ধারাবাহিকতায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনে বিএনপির প্রার্থী খালেদ হোসেন মাহবুব শ্যামলের পুনিয়াউটের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগ ক্যাডাররা। ব্যাপক ককটেল বিস্ফোরণ ও গুলি করে আতঙ্ক ছড়ানো হয় এলাকাবাসীর মধ্যে।
নির্বাচনের দিন সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের সংসদ সদস্য মহাজোট প্রার্থী মোকতাদির চৌধুরী রাজঘর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে যান। এ সময় কেন্দ্রে উপস্থিত বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ লাঠিপেটা ও গুলি করে। এ সময় এক যুবক নিহত হন। এ ঘটনার পরপর বিএনপির প্রার্থী খালেদ হোসেন মাহবুবের পুনিয়াউটের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
নাসিরনগরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা
জেলায় সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগরে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা। মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের এমপি মোকতাদির চৌধুরী রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে এই দাঙ্গার সৃষ্টি করেন। ঘটনার সূত্রপাত ২০১৬ সালের ২৯ অক্টোবর। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের রসরাজ দাস নামে এক হিন্দু যুবকের ফেসবুক আইডি থেকে পবিত্র কাবা শরিফের ওপর শিবমন্দিরের ছবি পোস্ট করা হয়।
এ খবর ছড়িয়ে পড়লে ওই এলাকায় তীব্র উত্তেজনা দেখা দেয়। স্থানীয়রা ওই যুবককে ধরে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। এরপরও তীব্র প্রতিবাদ অব্যাহত থাকে। কয়েকটি ইসলামি সংগঠন ও স্থানীয় মুসলমানরা পরদিন (৩০ অক্টোবর) প্রতিবাদ কর্মসূচির ডাক দেয়। পৃথক দুটি প্রতিবাদ কর্মসূচিতে হাজার হাজার মানুষ অংশ নেয়। প্রতিবাদ কর্মসূচি চলাকালীন একদল লোক বহু হিন্দু বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা-ভাঙচুর এবং লুটপাট চালায়।
ঘটনা ঘটার পরপরই সেই আসনের সংসদ সদস্য প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা ও তৎকালীন মৎস্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট ছায়েদুল হক সংবাদ সম্মেলন করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের সংসদ সদস্য মোকতাদির চৌধুরীকে এই হামলার সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ করেন। পরে ঘটনার তদন্তে নেমে মোকতাদিরের সহচর ও যুবলীগ নেতা আঁখিকে ঘটনার মূল হোতা হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তিনি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। কিন্তু এসব মামলায় আসামি করা হয় বিএনপি-জামায়াতসহ ইসলামি দলগুলোর নেতাকর্মীদের। এখনো এসব মামলায় ভুগছেন তারা।
আ.লীগের ক্ষমতাধর মন্ত্রী-এমপির ত্রাসের রাজত্ব
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ, মনোনয়ন ও বদলিবাণিজ্য, পছন্দের ঠিকাদারকে বৃহৎ প্রকল্পের কাজ দেওয়াসহ প্রতিটি সেক্টরে ছিল নৈরাজ্য। এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর-বিজয়নগর) আসনে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী উবায়দুল মোকতাদির, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (আখাউড়া-কসবা) আসনে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ (নাসিরনগর) আসনে বিএম ফরহাদ হোসেন সংগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ (বাঞ্ছারামপুর) আসনে ক্যাপ্টেন (অব.) তাজুল ইসলামের অঙ্গুলি হেলন ব্যতীত কোনো কিছুই হতো না। তাদের ভয়ে বিরোধীদলীয় নেতাদের পাশাপাশি নিজের দলের নেতাকর্মীরাও থাকতেন তটস্থ।
মূলত ২০১১ সালে উপনির্বাচনে শেখ হাসিনার সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী উবায়দুল মোকতাদির এমপি নির্বাচিত হওয়ার পরপরই পাল্টে যায় পুরো জেলার রাজনীতির চিত্র। বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের দমন-পীড়ন, মামলা দিয়ে দিনের পর দিন হয়রানি, গ্রেপ্তার আতঙ্ক, ইসলামধর্মীয় নেতাদের নিয়ে কটূক্তি—সবকিছুতেই ছিল তার বাড়াবাড়ি। এমনকি তার নিজ দলের নেতাকর্মীরাও রেহাই পাননি বিভিন্ন নির্মমতা থেকে। তার কূটকৌশলে ছাত্রলীগ হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য।
টেন্ডারবাণিজ্য, বালুমহালের নিয়ন্ত্রণ, বারবার একই পছন্দের ঠিকাদারকে দিয়ে কাজ করানো—সবকিছুই চলত উবায়দুল মোকতাদিরের ইশারায়। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কে প্রার্থী হবেন, তা দলীয় সিদ্ধান্তে নয়; বরং উবায়দুল মোকতাদিরের সিদ্ধান্তেই চূড়ান্ত হতো। কেউ তার বিরোধিতা করলে তাকে কোণঠাসা করে রাখা হতো।
অন্যদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (কসবা-আখাউড়া) আসনে মূর্তমান আতঙ্ক হয়ে ওঠেন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তার হামলা ও নির্মমতা থেকে বাদ যায়নি একই আসনের নিজ দলের সাবেক এমপি শাহ আলমও। বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ ভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা ছিলেন হামলা-মামলা ও জুলুম-নিপীড়নের শিকার। আনিসুলের হয়ে এপিএস রাশেদুল কায়সার ভুইয়া জীবন ও পৌর মেয়র এমরান উদ্দিন জুয়েল, কসবা উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মনির হোসেন, উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রিমন খানসহ বেশকিছু নেতা সীমান্ত দিয়ে অবৈধ গরুর চালান, অবৈধ গরুর হাট, মাদক পাচার, টেন্ডারবাজি, নিয়োগবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন।
এ ছাড়া রাশেদুল কায়সার, আখাউড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র মো. তাকজিল খলিফা কাজল এবং তার আপন ভাই ফোরকান আহমেদ খলিফা, আখাউড়া উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মুরাদ হোসেন, আনিসুল হকের পিএ আলাউদ্দিন বাবু, শফিকুল ইসলাম সোহাগ বিভিন্ন দুর্নীতি ও চোরাচালান, আখাউড়া স্থলবন্দরের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ এবং চাকরিবাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
মন্ত্রী ছায়েদুল হকের মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে বদরুদ্দোজা মো. ফরহাদ হোসেন সংগ্রাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ (নাসিরনগর) আসনে আওয়ামী লীগের এমপি হন। তিনি এমপি হওয়ার পর থেকে শান্ত এই জনপদ অশান্ত হয়ে ওঠে। হামলা-মামলা দিয়ে বিরোধী জনমতকে দমন-পীড়ন ছিল নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা। ২০১৮ সালের ২৬ মার্চ সংগ্রামের নির্দেশে বিএনপির দলীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠান চলাকালীন পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। এ সময় বিএনপির অর্ধশত নেতাকর্মী আহত হন। গ্রেপ্তার করা হয় ২০ জনকে। পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ছাত্রলীগের হামলায় নয়া দিগন্তের সাংবাদিক আসমত আলী আহত হন। বিএনপি চেয়ারপারসনের তৎকালীর উপদেষ্টা সৈয়দ একরামুজ্জামানের বাড়িতে হামলা চালানো হয়। রাতের আঁধারে বাড়ি থেকে বিতাড়িত করা হয় তাদের।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ (বাঞ্ছারামপুর) আসনে সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এবি তাজুল ইসলাম ছিলেন একক নিয়ন্ত্রক। তার এই নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে ছিলেন ভাগিনা উজানচর ইউপি চেয়ারম্যান কাজী জাদিদ আল রহমান জনি ও ভাতিজা তুষার। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প, ইউপি মেম্বার থেকে শুরু করে চেয়ারম্যান, মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদের সদস্য, দলীয় পদবাণিজ্য—সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি।
২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার পর ধরাকে সরা জ্ঞান করেন তাজুল। একইসঙ্গে তার ভাগিনা জনি চেয়ারম্যানের মাধ্যমে বাঞ্ছারামপুরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। বলতে গেলে ভাগিনা জনির কারণেই সীমাহীন অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট, স্বজনপ্রীতির পাশাপাশি প্রতিহিংসার রাজনীতি শুরু হয়। যার সর্বশেষ উদাহরণ উপজেলার সোনারামপুর ইউনিয়ন ছাত্রদলের নেতা নয়ন মিয়া হত্যাকাণ্ড।
২০২২ সালের ১৯ নভেম্বর বাঞ্ছারামপুর উপজেলা সদরের স্টিল ব্রিজের সামনে রফিকুল ইসলাম নয়নকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। মূলত বিএনপির সমাবেশ উপলক্ষে নয়ন বাঞ্ছারামপুরে লিফলেট বিতরণ করছিলেন। এ সময় তার সঙ্গে প্রায় দুই-আড়াইশ নেতাকর্মী ছিলেন। এ সময় পুলিশ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা অতর্কিত হামলা চালায়। তখন পুলিশের গুলিতে নিহত হন নয়ন।
জুলাই বিপ্লবে নিহত ২৭ জন
আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসন-অপশাসনের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে গর্জে উঠেছিল ছাত্র-জনতা। তারা অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দেশকে মুক্ত করেছিলেন আওয়ামী লীগের দুঃশাসন থেকে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অন্তত ২৭ জন ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান। এর মধ্যে মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের নাম সবার কাছেই পরিচিত। তিনি শহরের কাজীপাড়া এলাকার মোস্তাফিজুর রহমান বাবুলের ছেলে। এ ছাড়া অন্যান্য শহীদের মধ্যে রয়েছেন সদর উপজেলার বড়িশ্বল গ্রামের হোসেন (১২), নাসিরনগরের গোয়ালনগর গ্রামের মো. ইমরান (১৯), সরাইলের বারপাইকা গ্রামের জসীম মিয়া (৩৫), মলাইশ গ্রামের মোবারক হোসেন (১৩), ফহেতপুর গ্রামের হাফেজ মুফতি মাহমুদুল হাসান মাহদী (২৬), তেলিকান্দা গ্রামের মো. রায়হান উদ্দিন (১৯), বিজয়নগরের পত্তন গ্রামের ওমর (২০), নবীরগরের ভিটি বিশার গ্রামের ছাত্র জাহিদুজ্জামান তানভীর (২৬), থোল্লাকান্দি গ্রামের রফিক (১৮), গৌরনগর গ্রামের কামরুল ইসলাম (১৭), বিটঘর গ্রামের তানজিল মাহমুদ সুজন (১৯), নবীনগর পৌরসভার গোলাম নাফিজ (১৬), বাঞ্ছারামপুরের নতুনহাটি গ্রামের ইসমাইল (৫০), সোনারামপুর গ্রামের তুহিন (২৫), ছয়ফুল্লাকান্দি গ্রামের জিসান, ফরদাবাদ গ্রামের ইমরান (২১), দড়িকান্দি গ্রামের আশিকুর রহমান প্রমুখ।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতার বক্তব্য
কেন্দ্রীয় বিএনপির অর্থনীতিবিষয়ক সম্পাদক ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বিএনপির সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার খালেদ হোসেন মাহবুব শ্যামল বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পুরো সময়ে সারা দেশ ছিল আতঙ্কের নগরী। খুন, হামলা, মামলা, ভোটকেন্দ্র দখল—সবই ছিল তাদের জন্য মামুলি ব্যাপার। দেশের পুরো গণতন্ত্র ও স্বাভাবিকতা ধ্বংস করে দিয়েছিল তারা। একই ধারাবাহিকতায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়ও আওয়ামী হায়েনাদের থাবা ছিল ভয়ংকর। তারা কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডই পরিচালনা করতে দিত না।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া হেফাজতে ইসলামের সভাপতি মাওলানা মুফতি মোবারক উল্লাহ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আমাদের ওপর নির্যাতনের স্টিম রোলার চালানো হয়েছিল। আমাদের অনেক ছাত্র ও তৌহিদি জনতাকে তারা পাখির মতো গুলি করে হত্যা করেছে। যার বিচার আজও হয়নি। ২০২১ সালে নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ আগমনের প্রতিবাদ করায় আমাদের ১৬ ছাত্র ও তৌহিদি জনতাকে নির্বিচার গুলি করে হত্যা করা হয়। আহত হন শতাধিক।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক মেয়র হাফিজুর রহমান মোল্লা কচি বলেন, ‘জেলার রাজনীতির ইতিহাসে একসময় অত্যন্ত চমৎকার পরিবেশ ছিল। কিন্তু ২০০৯ সালের নির্বাচনের পর থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। এমনকি জেলার নাসিরনগরে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বাধিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের মামলা দিয়ে ও গ্রেপ্তার করে হয়রানি করা হয়েছে। অথচ মর্মান্তিক ওই ঘটনাটি ছিল আওয়ামী লীগের দুই সংসদ সদস্যের অন্তর্কোন্দলের জেরে।
জেলা জামায়াতের আমির মোবারক হোসেন আকন্দ বলেন, ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার বিগত সময়ে বিভীষিকাময় রাজত্ব কায়েম করেছিল। সে সময় আমাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৩০০ মামলা দেওয়া হয় এবং আসামি করা হয় প্রায় ১০ হাজার নেতাকর্মীকে। আর কারাগারে ছিল সাড়ে পাঁচ হাজারের মতো। এমনকি বিজয়নগর উপজেলার সাবেক আমির মাওলানা আবু তাহের রিমান্ডে অসুস্থ হয়ে পড়লে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান।
শুধু আবু তাহেরই নন, আমাদের অসংখ্য নেতাকর্মীকে এভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। ৩০ জনেরও বেশি নেতাকর্মী পুলিশি রিমান্ডে নির্যাতন এবং কারাগারে দীর্ঘদিন থাকার ফলে তারা এখন আর স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছেন না। আমরা এসব ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করছি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দিদারুল আলম বলেন, ‘গত ১৫ বছরে হওয়া ৪২৭টির মতো হয়রানিমূলক রাজনৈতিক মামলার যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত আইন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। এর মধ্য আইন মন্ত্রণালয় থেকে ২৫৭টি মামলা অব্যাহতির নিদের্শনা এসেছে এবং আরো ৬৭টি মামলা অব্যাহতির নির্দেশনা আসে।
বাকিগুলো যথাযথ কাগজপত্র সংকটে আরো যাচাই-বাছাই করার জন্য আমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। এসব মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে, তাদের সঠিক কাগজপত্র পেতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। কারণ, ৫ আগস্টের ঘটনায় থানা পুড়ে যাওয়ায় পুলিশের কাছ থেকে ডকুমেন্ট পাওয়া যাচ্ছে না। তারপরও মামলার বাদী, পিপি, তদন্তকারী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে।
সূত্র: আমার দেশ।