Home » মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্টে ১২ হাজারের বেশি সিবিসি পরীক্ষা

মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্টে ১২ হাজারের বেশি সিবিসি পরীক্ষা

স্বাস্থ্য খাতের দুরবস্থা

0 মন্তব্য গুলি 3 জন দেখেছে 4 মিনিট পড়েছেন

মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট ব্যবহার করে ১২ হাজারের বেশি রোগীর রক্তের পরীক্ষা (সিবিসি) করেছে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। এ ঘটনায় হাসপাতালটির প্যাথলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্বে থাকা ডা. আব্দুল্লাহ আল মুয়ীদ খান, মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব ইনচার্জ) গণেশ চন্দ্র ও কর্মরত টেকনোলজিস্টরা অবহিত ছিলেন।

হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগে গিয়ে দেখা গেছে, সিবিসি (কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট) পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত ২১৯ নম্বর কক্ষটি জনশূন্য। পাশের কক্ষে বসে থাকা কর্মরত দুজন জানান, রি-এজেন্ট না থাকায় গত ১৪ আগস্ট থেকে সিবিসি পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে।

আগামী শনিবার নতুন রি-এজেন্ট এলে আবার সিবিসি পরীক্ষা চালু হবে।

চিকিৎসকদের মতে, সিবিসি পরীক্ষা শরীরের সামগ্রিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে তথ্য দেয়। যেমন— সংক্রমণ নির্ণয়, রক্তস্বল্পতা (অ্যানিমিয়া), রক্তের ক্যান্সার শনাক্তকরণ, ওষুধের প্রভাব ও চিকিৎসা পর্যবেক্ষণ, এ ছাড়া প্রদাহ বা অন্যান্য স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণ নির্ণয়ে সাহায্য করে।

banner

তাঁরা বলছেন, মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট ব্যবহারে সঠিক ও নির্ভুল রোগ নির্ণয় সম্ভব নয়।

রোগীর স্বাস্থ্যের মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি হয়, যা স্বাস্থ্যসেবার মান ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় বড় উদ্বেগ সৃষ্টি করে।

সিবিসি পরীক্ষার জন্য তিন ধরনের রি-এজেন্ট প্রয়োজন। ক্লিনার, লায়সি ও ডাইলুয়েন্ট। হাসপাতাল সূত্রে পাওয়া এসব রি-এজেন্টের কিছু ছবি আসে কালের কণ্ঠের হাতে।

এতে দেখা যায়, ক্লিনার রি-এজেন্টের গায়ে মেয়াদ লেখা আছে ১৮ জুন ২০২৫, আর লায়সির গায়ে ১৪ জুলাই ২০২৫। ডাইলুয়েন্টের মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখ উল্লেখ রয়েছে ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫। অর্থাৎ ছুটির দিন বাদে মেয়াদোত্তীর্ণ প্রথম রি-এজেন্ট ব্যবহার করে রক্ত পরীক্ষা করা হয়েছে ৪৯ দিন এবং প্রথম ও দ্বিতীয় মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট ব্যবহার করে পরীক্ষা করা হয়েছে ২৭ দিন।

প্যাথলজি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালটিতে প্রতিদিন গড়ে ২৫০টি সিবিসি পরীক্ষা করা হয়। সে অনুযায়ী মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট দিয়ে ১২ হাজার ২৫০ জন রোগী সিবিসি পরীক্ষা করা হয়েছে।

হাসপাতালের এ বিভাগের একাধিক টেকনোলজিস্ট জানান, মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্টের বিষয়টি বিভাগীয় প্রধান ও ল্যাব-ইনচার্জকে অবহিত করা হলেও তা গোপন রাখার পরামর্শ দেন।

এ বিষয়ে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্বে থাকা ডা. আব্দুল্লাহ আল মুয়ীদ খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি আর প্যাথলজি বিভাগের দায়িত্বে নেই। এ ছাড়া এ বিষয়ে তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে এ প্রশ্নের উত্তর জানতে পারবেন।’

মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট দিয়ে পরীক্ষার বিষয়টি স্বীকার করেছেন হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘এটা খুবই সাধারণ বিষয়। আপনি যে ওষুধ খান, এর গায়ে থাকা মেয়াদ শেষ হলে কি সেটা জিরো হয়ে গেল?’

তিনি বলেন, ‘যেকোনো কেমিক্যাল বা ওষুধের নিয়ম হলো, মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ থেকে তিন থেকে ছয় মাস এর কার্যকারিতা বজায় থাকার নিশ্চিয়তা দিতে হয়। তবে মেয়াদোত্তীর্ণ হলে কার্যকারিতা শতভাগ না-ও আসতে পারে।’

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ক্লিনিক্যাল বায়োকেমিস্টের (বিএসিবি) যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক ফাতেমা খান মজলিস কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কোনো আদর্শ ল্যাব কখনো মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট ব্যবহার করে না। কারণ মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্টে শতভাগ নির্ভুল তথ্য দেয় না। এ ছাড়া স্বাস্থ্য পরীক্ষায় সঠিক ও নির্ভুল তথ্যের জন্য ল্যাবের কিউসি কন্ট্রোল (কোয়ালিটি কন্ট্রোল) যাচাই জরুরি, যা আমাদের দেশের বেশির ভাগ ল্যাবে করা হয় না। নিয়ম হলো, প্রতিদিন অন্তত একবার কিউসি যাচাই করা। নয়তো মেশিন নির্ভরশীল তথ্য ভুল হওয়ার আশঙ্কা থাকে।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাসপাতালটির প্যাথলজি বিভাগে ২১টি টেস্ট, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে ৯টি, বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে ১৮টি এবং ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগে পাঁচটি পরীক্ষা করার কথা। এর মধ্যে প্যাথলজি বিভাগে টেস্ট বন্ধ হতে হতে শুধু সিবিসিতে এসে ঠেকেছে। সেটিও মেশিননির্ভর। নিয়ম থাকা সত্ত্বেও কিউসি পদ্ধতি এখানে নেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্যাথলজি বিভাগের এক টেকনেশিয়ান জানান, এরই  মধ্যে আট লাখ টাকার রি-এজেন্ট মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে, আরো ১৫ লাখ টাকার রি-এজেন্ট রয়েছে—সামনের মাসে মেয়াদোত্তীর্ণ হবে।

অনুমতি ছাড়াই মেশিন স্থাপন : হাসপাতালটির স্টোরে গিয়ে দেখা যায়, নতুন প্যাকেটজাত অবস্থায় পড়ে আছে স্পেনের অত্যাধুনিক হেমাটোলজি অ্যানালাইজার (৫ পার্টস), মাল্টি চ্যানেল কো-এগুলেশন অ্যানালাইজার এবং বিএ-২১০ মডেলের মাইক্রোস্কোপ। এগুলো হাসপাতালে বিনামূল্যে দিয়েছিল রি-এজেন্ট  সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান রজনীগন্ধা ইন্টারন্যাশনাল। প্রতিষ্ঠানটি স্পেন থেকে প্রকৌশলী আনে মেশিন স্থাপনের জন্য। কিন্তু কোনো অনুমতি না পেয়ে তারা ফিরে গেছেন। এর পর থেকে হাসপাতালের স্টোরে পড়ে আছে মেশিনগুলো।

হাসপাতালে এসব মেশিন পড়ে থাকার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, মেশিন স্থাপনের সুযোগে বেশি দামে রি-এজেন্ট বিক্রি করেন ব্যবসায়ীরা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও তাদের বাইরে অন্য কারো কাছ থেকে রি-এজেন্ট কিনতে পারে না।

সম্প্রতি হাসপাতালটিতে এবিসি করপোরেশন নামের এক রি-এজেন্ট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিনামূল্যে আরো ছয়টি মেশিন নেন প্যাথলজি বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্বে থাকা ডা. আব্দুল্লাহ আল মুয়ীদ খান। গত ৭ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টার পর বায়োকেমিস্ট্রি অ্যানালাইজার ও ইমিউনোকেমিস্ট্রি অ্যানালাইজার দুটি মেশিন স্থাপনও হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও হাসপাতাল পরিচালকের অনুমতি নেওয়া হয়নি।

এ বিষয়ে হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা এর জবাবদিহি চেয়েছি। কারণ সরকারি যেকোনো কাজে নিয়ম-নীতি রয়েছে।’

“সুত্র: দৈনিক কালেরকন্ঠ”

এই সম্পর্কিত আরো পোস্ট দেখতে পারেন

কমেন্ট লিখুন