Home » পারিবারিক আদালতের কাঁধে ৯০ হাজার মামলার বোঝা

পারিবারিক আদালতের কাঁধে ৯০ হাজার মামলার বোঝা

0 মন্তব্য গুলি 3 জন দেখেছে 4 মিনিট পড়েছেন

বিচারের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আদালতের বারান্দায় ঘুরছেন সিরাজগঞ্জের ইয়াকুব। ২০১৯ সালে ছেলেকে ফেরত চেয়ে মামলা করেন পারিবারিক আদালতে। এর আগে স্ত্রী সুমির সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হয়। ইয়াকুব ও সুমির ঘরে জন্ম নেওয়া ইউসুফের বয়স এখন ৭ বছর। বিয়ে বিচ্ছেদের পর সন্তান ইউসুফকে সঙ্গে নিয়ে সুমি আরেকজনকে বিয়ে করেন। সেখানেই সংসার করছেন তিনি। ছেলে ইউসুফকে আর ফেরত পাননি ইয়াকুব। মামলার পর অর্ধযুগ পার হলেও এর কোনো সুরাহা হচ্ছে না।

শুধু ইয়াকুবই নন, এভাবে পারিবারিক আদালতের বারান্দায় বছরের পর বছর ঘুরছেন অসংখ্য মানুষ। কোনো কোনো মামলা ৮ থেকে ১০ বছর ধরেও ঝুলে থাকতে দেখা গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারাদেশে পারিবারিক আদালতগুলোর কাঁধে বিচারাধীন ৯০ হাজার মামলার বোঝা। এর মধ্যে ঢাকার তিনটি পারিবারিক আদালতেই ঝুলছে ১৩ হাজার মামলা। ঢাকায় ২৬ বছরে মামলার সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি আদালত।

ভুক্তভোগীরা জানান, মামলার চাপে কয়েক মাস পরপর শুনানির তারিখ আসছে। শুনানির এই তারিখও তদবির ছাড়া স্বল্প সময়ে মেলে না। আবার তারিখ পড়লেও শুনানি না হওয়ায় ফিরে যেতে হয় বিচারপ্রার্থীদের। এই ভোগান্তির মাঝে নতুন করে চোখ রাঙাচ্ছে পারিবারিক মামলা নিয়ে নতুন অধ্যাদেশ। আদালতে আসার আগে মামলা নিয়ে বিচারপ্রার্থীদের যেতে হবে লিগ্যাল এইড অফিসে। লিগ্যাল এইড অফিসের পরিধি না বাড়ালে এমন সিদ্ধান্ত ভোগান্তি কমানোর চেয়ে বরং বাড়াবে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেনমোহর ও ভরণপোষণের দাবিতে ঢাকার পারিবারিক আদালতে মামলা করেন করিম (ছদ্মনাম)। মামলার পর ২০২২ সালের ২৭ অক্টোবর রিমাকে দেনমোহরের ২ লাখ ৫০ হাজার টাকাসহ তার ও মেয়ের ভরণ-পোষণ বাবদ মোট ১০ লাখ ২০ হাজার টাকা দিতে রায় দেন ঢাকার তৃতীয় পারিবারিক আদালত। সেই মামলার আজও নিষ্পত্তি হয়নি।

এভাবে পারিবারিক কলহের জেরে দায়ের করা মামলায় ভোগান্তির শেষ নেই বিচারপ্রার্থীদের। বিচারের জন্য বছরের পর বছর ঘুরতে হচ্ছে আদালতের বারান্দায়। পারিবারিক মামলা বিশেষ করে সন্তানের অভিভাবকত্ব নিয়ে পারিবারিক আদালতে থাকা মামলাগুলো ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে নির্দেশনা রয়েছে উচ্চ আদালতের। কিন্তু মানা হচ্ছে না এই নির্দেশনা।

banner

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মামলা জট কমবে যদি আদালতের বাইরে এসব মামলা নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়। এসব মামলা বাদী-বিবাদীদের মনমানসিকতার ওপরেও অনেক কিছু নির্ভর করে।

হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মনজিল মোরসেদ এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘পারিবারিক মামলা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এখন নতুন আইনের উদ্দেশ্য ভালো। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষেরা সহজে মীমাংসা করতে চায় না। মীমাংসা না হলে নতুন করে আবার কোর্টে যেতে হয়। সরকারের নতুন আইন মানুষের মন-মানসিকতার ওপর নির্ভর করবে। ট্রায়াল করে মামলা না করে জনগণকে সচেতন হতে হবে। মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে সামাজিক বা অন্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। মানসিকতারকে পরিবর্তন করতে হবে। এটা নিয়ে গুরুত্ব দেওয়া  উচিত।’

সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার সানজিদ সিদ্দিকী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘পারিবিারিক আদালতে মূলত ৫ ধরনের মামলা করা হয়। দেনমোহর ভরণ পোষণসহ অন্যান্য বিষয়ে। এসব মামলার নিষ্পত্তিতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি কাজে লাগানো উচিত। বাদি বিবাদী উভয়পক্ষকে বসে এসব ম্যাটার সমাধান করতে পারেন, আদালত বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কোনো একজন ব্যাক্তিকে ঠিক করে দিতে পারেন। বাইরে এসব ম্যাটার মীমাংসা হলে কোর্টে মামলার চাপ কমবে। পারিবারিক মামলাগুলো দেওয়ানি প্রকৃতির। সমন জারি,  নোটিশ ফেরত আসার ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এক্ষেত্রে বেশি সময় লাগবে না। একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে হবে।

২০২১ সালের ৭ নভেম্বর পারিবারিক এক মামলার রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ সন্তানের অভিভাবকত্ব নিয়ে পারিবারিক আদালতে থাকা মামলাগুলো ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে নির্দেশনা দেন। কিন্তু তারপর আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।

সরেজমিন ঢাকার তিনটি পারিবারিক আদালত ঘুরে দেখা যায়, ছোট্ট এজলাস কক্ষ। প্রতিটি কক্ষই নথিতে ভরা, এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে আছে। ভেতরে বেঞ্চ সীমিত। ৮ থেকে ১০ জনের বেশি বসার সুযোগ নেই। তাই বাধ্য হয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় বিচারপ্রার্থীদের। আশপাশে নেই কোনো বিশ্রামাগার। এ ছাড়া শৌচাগার সংকট এ কোর্টের দীর্ঘদিনের সমস্যা। বিচারপ্রার্থী বিশেষ করে নারী ও শিশুদের জন্য চরম ভোগান্তি বয়ে আনছে পারিবারিক মামলা।

কয়েক দশক ধরে পারিবারিক মামলা নিয়ে কাজ করা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনির হোসেন বলেন, ২০০০ সালে ঢাকায় পারিবারিক আদালতের সংখ্যা ছিল তিনটি। ২৬ বছর পরও সেই তিনটিই আছে। অথচ এখন মামলা বেড়েছে বহুগুণ। এই ২৬ বছরে নারী ও শিশু আদালত ঢাকায় একটি থেকে এখন নয়টি হয়েছে। অর্থঋণ আদালত চারটি থেকে এখন সাতটি হচ্ছে। সিএমএম কোর্ট বেড়েছে। তাহলে পারিবারিক আদালত বাড়ছে না কেন?

এই আইনজীবী বলেন, নতুন করে যে অধ্যাদেশ হলো, তাতে পারিবারিক আদালতে আসার আগে মামলা লিগ্যাল এইড অফিসে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে। এতে মামলায় ভোগান্তি আরও বাড়বে। কারণ, লিগ্যাল এইড অফিসের পরিধি ছোট। যথাযথ পরিকল্পনা নিয়ে পরিধি না বাড়ালে তিন কোর্টের সব মামলা একটি অফিসে গেলে ভোগান্তি বাড়বে ছাড়া কমবে না।

“সুত্র: ঢাকা মেইল”

 

 

এই সম্পর্কিত আরো পোস্ট দেখতে পারেন

কমেন্ট লিখুন