Home » দিনাজপুরে দুই শতাব্দীর ঐতিহ্যবাহী ‘বাসিয়া হাটি’ মেলা

দিনাজপুরে দুই শতাব্দীর ঐতিহ্যবাহী ‘বাসিয়া হাটি’ মেলা

0 মন্তব্য গুলি 2 জন দেখেছে 2 মিনিট পড়েছেন

তৃণমূলের সংবাদ ডেস্ক :
শুক্রবার দুপুর গড়িয়ে বিকাল। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা মানুষের পদচারণায় মুখরিত দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার গোলাপগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ। কাচের চুড়ির টুংটাং শব্দ, ঢাক-ঢোলের বাজনা আর মাইক থেকে ভেসে আসা আদিবাসীদের গানের সুরের মূর্ছনায় মেতেছে পুরো এলাকা।

এ দৃশ্য দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে চলা অনন্ত এক উৎসব, যা সবার কাছে ‘বাসিয়া হাটি’ নামে পরিচিত। এ মেলায় পছন্দের জীবনসঙ্গীও খুঁজে নেন তরুণ-তরুণীরা।

প্রতি বছর দুর্গাপূজার বিজয়া দশমীর পরের দিন দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার গোলাপগঞ্জ এলাকায় আয়োজিত এ মেলায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ ছুটে আসেন।

মেলায় সবচেয়ে বেশি নজর কাড়ে তরুণ-তরুণীদের সাজসজ্জা। রঙিন শাড়ি, মাথায় ফুল, হাতে কাঁচের চুড়ি, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক— একেকজন যেন রঙের উৎসবে হারিয়ে যান তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির ভেলায়। মেলার মাঠে দোকানের পসরা চোখে পড়ার মতো। কাচের চুড়ি, রঙিন ফিতা, ঝিনুক, মাটির পাত্র থেকে শুরু করে গৃহস্থালির দা-কুড়াল, হাঁড়ি-পাতিল সবই মেলে একসঙ্গে।

banner

এই মেলা শুধু কেনাকাটার আয়োজন নয়—এ যেন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষদের এক সামাজিক উৎসব ও মিলনমেলা। দিনভর চলে নাচ-গান, বাজনার তালে দলগত পরিবেশনা আর তরুণ-তরুণীদের আড্ডা। শুধু সাঁওতাল নয়, হিন্দু-মুসলিমসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষও মেতে ওঠেন এই উৎসবে। মেলায় এত ভিড় হয় যে, মোবাইল নেটওয়ার্কও কাজ করতে হিমশিম খায়।

প্রতি বছরের মতো এবারো শারদীয় দুর্গোৎসবের পরের দিন শুক্রবার (৩ অক্টোবর) বিকাল ৪টা থেকে দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, রাজশাহী, বগুড়া, পঞ্চগড় ও নীলফামারী থেকে আসা সাঁওতাল সম্প্রদায়ের হাজারও নারী-পুরুষ ভিড় জমিয়েছেন উপজেলার গোলাপগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে। সঙ্গে ছিলেন অন্য সম্প্রদায়ের মানুষও।

দুইশ বছরের ঐতিহ্য ধরে চলে আসা এই মেলা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর আত্মীয়-স্বজনদের মিলনমেলায় পরিণত হলেও এর বিশেষ আকর্ষণ হলো যুবকদের পছন্দের জীবনসঙ্গী খুঁজে নেওয়ার সুযোগ। এখানে তরুণ-তরুণীরা একে অপরকে পছন্দ করলে পরিবারের মাধ্যমে আলোচনার পরে বিয়ে হয় বলে প্রচলন আছে।

মেলায় আসা আদিবাসী তরুণী এঞ্জিলিনা মার্ডি বলেন, “এক সময় এই মেলায় জীবনসঙ্গী খুঁজে নেওয়ার প্রচলন ছিল বলে শুনেছি। তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় সব বদলে গেছে। এখন এই রীতিতে ভাটা পড়েছে। সময়ের সঙ্গে আদিবাসীদের জীবনযাত্রার মান অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বেশিরভাগ ছেলে-মেয়ে এখন স্কুলমুখী। কালের বিবর্তনে পুরোনো ঐতিহ্যগুলো অনেকটাই মুছে যেতে বসেছে।”

আদিবাসী সমাজ উন্নয়ন সমিতির আহ্বায়ক জোসেফ হেমরম বলেন, “পূর্বপুরুষেরা এই মেলা শুরু করেন। আমরা শুধু ধারাবাহিকতা রক্ষা করছি। তবে কবে থেকে এ মেলার প্রচলন শুরু হয়েছে সেটি সঠিকভাবে বলা যাবে না। আনুমানিক দুশ বছর ধরে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এটি বাপ-দাদার কাছে শুনেছি। তবে বিয়ের বিষয়টি আগের মতো করে এখন আর হয় না। মেলা অনুষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারে এলাকার সব ধর্ম ও বর্ণের মানুষ সহযোগিতা করেন।”

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি, বিশিষ্ট সমাজসেবক ও কেন্দ্রীয় কৃষক দলের নির্বাহী কমিটির সদস্য মনজুরুল ইসলাম মনজু বলেন, “এই মেলা আমাদের দীর্ঘ দিনের সম্প্রীতির নিদর্শন। এই মেলায় সব ধর্ম ও বর্ণের মানুষ ছুটে আসেন। এখানে মানুষ খুঁজে পায় তাদের সংস্কৃতি ও সম্প্রীতির বন্ধন। কয়েকশ বছরের পুরোনো এই মেলা যেন আমাদের আত্মার সঙ্গে মিশে গেছে। যেখানে শুধু স্নেহ ও ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ থাকে আমাদের বিবেকবোধ।”

এই সম্পর্কিত আরো পোস্ট দেখতে পারেন

কমেন্ট লিখুন