বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে ‘মিয়া ভাই’ নামটি বললে যে মুখটি সবার চোখে ভেসে ওঠে, তিনি চিত্রনায়ক ফারুক। ১৯৭০-এর দশক থেকে শুরু করে দীর্ঘ সময় ধরে তিনি ছিলেন দর্শক হৃদয়ের সবচেয়ে প্রিয় নায়ক।
নব্বই দশকের শুরুতে সিনেমায় তাঁর ব্যস্ততা কমে গেলে, তখন রাজধানীর বারিধারার পার্ক রোডে নির্মাণকাজ শুরু করেছিলেন ‘সাংরে বাড়ী’র। একসময় সেটি পূর্ণতাও পায়। তবে পুরোনো দোতলা বাড়িটি আজ আর নেই। সেখানে গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন। ২০২১ সালে ফারুক সারেং বাড়ীর জায়গাটি দিয়ে দেন একটি স্বনামধন্য নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের কাছে। প্রতিষ্ঠানটি পুরোনো বাড়ি ভেঙে একই নামে করেছে বহুতল ভবন। স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি হারিয়ে সে সময় তীব্র কষ্টের মুখোমুখি হয়েছিলেন ফারুক।
অনেক আগে থেকেই ফারুকের শরীরে বাসা বেঁধেছিল নানা অসুখ। একসময় চিকিৎসার জন্য তাঁকে যেতে হয় সিঙ্গাপুর। দীর্ঘদিন ধরে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চলে তাঁর চিকিৎসা। পাশাপাশি চলছিল বাড়ির নির্মাণকাজ। তবে নতুন বাড়িটি তিনি দেখে যেতে পারেননি। এর আগেই চলে যান না ফেরার দেশে।
গত রোববার বাড়িটির ছবি তোলার জন্য গেটের সামনে যেতেই দেখা হয় নিরাপত্তাকর্মী লক্ষ্মণের সঙ্গে। তাঁর কাছে জানতে চাইলাম বাড়িটির কথা। তিনি বলেন, ‘চিত্রনায়ক ফারুক সাহেবের জায়গার ওপরই হয়েছে এই বাড়ি। অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। তাঁর অভিনীত সিনেমা আমি দেখেছি। করোনার সময় সর্বশেষ তিনি এখানে এসেছিলেন। এরপর আর আসেননি। শেষবার যখন এসেছিলেন, তখন বাড়ির সামনে অবাক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন। মনে হয় পুরোনো দিনের কথা ভাবছিলেন তিনি।’
‘সারেং বাড়ী’ নামটি এসেছে ফারুকের ক্যারিয়ারের অন্যতম কালজয়ী ছবি ‘সারেং বউ’ থেকে। ১৯৭৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এ সিনেমায় ফারুক অভিনয় করেছিলেন ‘ কদম সারেং চরিত্রে। আর তাঁর স্ত্রী ‘নবীতুন’ চরিত্রে ছিলেন কবরী সারোয়ার। ছবিটি ফারুককে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দেয়।
সমুদ্রের সঙ্গে জীবনযুদ্ধ, দাম্পত্য সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং ভালোবাসার গভীরতা সিনেমাটিকে কালজয়ী করে তোলে। এই ছবির সাফল্যের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থেকেই ফারুক নিজের বাড়ির নাম রেখেছিলেন সারেং বাড়ী। সেই নাম শুধু সিনেমার প্রতি নয়, তাঁর অভিনয়জীবনের সেরা সময়ের স্মৃতির প্রতীকও ছিল।
বারিধারার পার্ক রোডে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িটি একসময় ছিল চলচ্চিত্র অঙ্গনের মানুষের আড্ডার স্থান। বন্ধুবান্ধব, সহশিল্পী, সাংবাদিক– সবাই জানতেন, সারেং বাড়ী মানেই ফারুকের ভালোবাসা, অতিথিপরায়ণতা আর গল্পের ভান্ডার। কিন্তু সময় ফারুককে কঠিন বাস্তবতায় দাঁড় করায়। তিনি যখন সিদ্ধান্ত নিলেন বাড়িটি ডেভেলপার কোম্পানিকে দেওয়ার, তখন শিল্পী, সহকর্মী ও ভক্তদের কাছে খবরটি ছিল বেদনাদায়ক।
বাড়িটি নিয়ে ফারুকের স্ত্রী ফারহানা ফারুক বলেন, “ফারুকের সঙ্গে আমার বিয়ে হয় ১৯৯২ সালে। বিয়ের পর বারিধারার ‘সারেং বাড়ী’তে উঠেছিলাম। তখন দোতলা বাড়িটির নির্মাণকাজ প্রায় শেষের দিকে। ফারুক নিজেই কাজ দেখভাল করত। ছাদে হয়েছিল বিয়ের আয়োজন। ওই বাড়িতে আমরা তিন বছর ছিলাম। কতশত স্মৃতি রয়েছে বাড়িটি ঘিরে– সবই চোখে জ্বলজ্বল করছে। সেখান থেকেই উত্তরার বাসায় এসেছি। ওই বাড়িতে আমার মেয়ের জন্ম। বিয়ের পর প্রথম ঈদ করেছি। ঘরোয়াভাবে ফারুকের জন্মদিনও করেছি। তাঁর সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত ছিল আনন্দময়। ফারুক সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা করতে যাওয়ার আগেই একটি কনস্ট্রাকশন কোম্পানির কাছে বাড়ির জায়গা দিয়ে দিয়েছিলাম। ওই ভবনে এখন আমাদের দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে। ফারুকের পছন্দে বাড়িটির নাম সারেং বাড়ী রাখা হয়েছে। তাঁর প্রতি সম্মান জানাতেই নির্মাণ প্রতিষ্ঠান এখন বড় করে বাড়ির সামনে সারেং বাড়ী নামফলক টানিয়ে রেখেছে। এটি এখন সবার কাছে স্মৃতির সারেং বাড়ী।”
আজ ১৮ আগস্ট, ফারুকের জন্মদিন। বেঁচে থাকলে এই দিন তিনি ৭৭ বছর পার করতেন। এখন তিনি নেই, কিন্তু তাঁর সিনেমা, তাঁর স্মৃতি আর সেই প্রিয় বাড়ির গল্প মানুষের মনে বেঁচে থাকবে।
“সুত্র: দৈনিক সমকাল”