Home » চিংড়ির বদলে তরমুজ চাষ

চিংড়ির বদলে তরমুজ চাষ

0 মন্তব্য গুলি 3 জন দেখেছে 3 মিনিট পড়েছেন

একসময় খুলনার বটিয়াঘাটার রাজা খাঁর বিল ভরে থাকত লবণপানিতে। ওই পানিতে চাষ হতো। মহাজনরা জমি দখলে নিয়ে ঘের তৈরি করতেন। বিঘাপ্রতি জমিতে সারা বছরের ‘হাড়ি’ বা জমি ব্যবহারের মূল্য পাওয়া যেত সর্বোচ্চ আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা।

কৃষকের হাতে থাকত না কোনো লাভ। চাষাবাদ হারিয়ে কৃষকরা হয়ে পড়েছিলেন নিঃস্ব। কিন্তু ওই দৃশ্যপট এখন আর নেই। দুই বছর ধরে স্থানীয়রা একত্রিত হয়ে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। চিংড়ির মহাজনদের বিদায় করেছেন তারা। লবণপানির ঘের ভেঙে দিয়েছেন। এখন সেখানে সারা বছর ধরে চাষ হচ্ছে নানা ফসল। জমি থেকে উঠছে ধান, মাছ, সবজি আর তরমুজ। যেসব বিল একসময় দুঃখের প্রতীক ছিল। এখন কৃষিতে বদলেছে গ্রামীণ অর্থনীতি।

গাওঘড়া রাজা খাঁর বিলে প্রায় সাড়ে ৭০০ বিঘা জমি রয়েছে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে এর মধ্যে প্রায় ৫০০ বিঘা জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছে। চাষিরা বলছেন, মাত্র দুই থেকে আড়াই মাসের মধ্যে এক বিঘা জমি থেকে তরমুজ বিক্রি করে মিলছে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। এই আয় একসময় তাদের কল্পনার বাইরে ছিল।

কৃষি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ অঞ্চলে বর্ষাকালে সময়ে ঘেরের পাড়ে মাচা তৈরি করে তাতে তরমুজের চারা রোপণ করা হয়। জুন মাসে এই চাষ শুরু হয়। আগস্টের মাঝামাঝি থেকে তরমুজ বাজারজাত শুরু হয়। ইতোমধ্যে ফলন্ত তরমুজ গাছের পাশে আবার নতুন চারা রোপণ করা হয়। এতে নভেম্বরের শেষ নাগাদ শীত মৌসুমেও পাওয়া যায় নতুন চালানের তরমুজ। এভাবে মাত্র ছয় মাসে একই জমিতে দুবার তরমুজ সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে। পাশাপাশি ঘেরে মাছ, পানি শুকালে ধান এবং পাড়ে বিভিন্ন সবজির আবাদও চলছে।

banner

বটিয়াঘাটার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা অঞ্জন কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘অসময়ের তরমুজ চাষ লাভজনক হওয়ায় এখানে কৃষির ধরনই বদলে গেছে। আগে যেখানে জমি বছরের পর বছর পতিত থাকত কিংবা মহাজনের ঘেরের দখলে থাকত, এখন সেখানে চাষিরা খোরপোশ কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হয়েছেন। গত দুই বছরের মধ্যেই বিলের চেহারা সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। কেউ জমি ফেলে রাখছেন না। সবাই এখন তরমুজ চাষে ঝুঁকছেন। কারণ এতে ভালো আয় হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘একসময় এ অঞ্চলে লবণপানির কারণে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হতেন। এখন একই জমিতে তরমুজ, ধান, মাছ ও সবজির আবাদ করে তারা লাভবান হচ্ছেন। অর্থনৈতিক অবস্থারও ব্যাপক উন্নতি হয়েছে।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে শুধু খুলনা জেলায় প্রায় ৯৬৬ হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদ হয়েছে। এর থেকে প্রায় ৩০ হাজার টন তরমুজ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে বর্ষাকালীন তরমুজ হওয়ায় এর চাহিদা বাজারে বেশি, ফলে কৃষকেরা ভালো দাম পাচ্ছেন।

স্থানীয় কৃষক বিশ্বজিৎ ঘরামী বলেন, ‘আগে এ বিলের জমি শুধু মহাজনের কাজে লাগত। আমরা কষ্ট করে জীবন চালাতাম। এখন একের পর এক ফসল ফলিয়ে আমাদের জীবনযাত্রা বদলে গেছে। এক বিঘা জমিতে দুই দফায় তরমুজ বিক্রি করে যা আয় হয়, তা দিয়েই সারা বছরের সংসারের খরচ উঠে যায়। আগে যা ছিল স্বপ্ন, এখন তা বাস্তব।’ তিনি আরও জানান, এক মৌসুমে এক বিঘা জমি থেকে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ করা যায়। আর দুই মৌসুমে তরমুজ বিক্রি করলে ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় হয়। শুধু তরমুজ নয়, ঘেরের পাড়ে সবজি, ঘেরে মাছ আর ধান চাষ করেও বাড়তি লাভ করছেন তারা।

বটিয়াঘাটা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘প্রথমবারের মতো বর্ষাকালীন অফ-সিজনের তরমুজ চাষে খুলনায় ব্যাপক সফলতা পেয়েছেন কৃষকরা। নিচু জমিতে বর্ষায় পানি জমলে চাষিরা ঘেরের পাড়ে মাচায় তরমুজ ফলাচ্ছেন। অসময়ের তরমুজ হওয়ায় এর বাজারমূল্য অনেক বেশি। ফলে কৃষকরা যেমন লাভবান হচ্ছেন, তেমনি স্থানীয় অর্থনীতিও চাঙা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘এ অঞ্চলের কৃষকরা এখন একই জমিতে একাধিক ফসল উৎপাদনে ঝুঁকছেন। শস্যের নিবিড়তা যেমন বাড়ছে, তেমনি চাষিদের আয়ও বাড়ছে। কৃষি এখন আর শুধু জীবনধারণের উপায় নয়, বরং লাভজনক পেশায় রূপ নিচ্ছে।’

“সুত্র: দৈনিক খবরের কাগজ”

এই সম্পর্কিত আরো পোস্ট দেখতে পারেন

কমেন্ট লিখুন