Home » চাঞ্চল্যকর মামলায় অস্বাভাবিক জামিন

চাঞ্চল্যকর মামলায় অস্বাভাবিক জামিন

কুষ্টিয়ার দুই আদালত

0 মন্তব্য গুলি 3 জন দেখেছে 4 মিনিট পড়েছেন

*একদিনও হাজতবাস করেননি তিন ও দুই খুনের মামলার ২১ আসামি
* তিন খুনের ১৪ আসামি জেল খেটেছেন মাত্র দুদিন
* হরহামেশাই জামিন পাচ্ছেন অস্ত্র মামলার আসামিরা

কুষ্টিয়ার আদালতে চাঞ্চল্যকর মামলার আসামিদের অস্বাভাবিক জামিন ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। চাঞ্চল্যকর ট্রিপল ও ডাবল হত্যা মামলার ২১ আসামিকে জেলে যেতে হয়নি। কারাগারে না পাঠিয়েই এসব আসামির জামিন মঞ্জুর করেছেন আদালত। আলোচিত অস্ত্র মামলার আসামিদেরও জামিন মিলছে অল্পদিনে। এভাবে একের পর এক কারাগার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন সন্ত্রাসীরা। পুলিশ বলছে, অল্পদিনের ব্যবধানে সহজেই জামিনে মুক্তি পেয়ে পুনরায় অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন আসামিরা। নৃশংস হত্যা মামলার আসামিদের জামিন দেওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন বাদীপক্ষের লোকজন। ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা। আর আইনজীবীরা বলছেন, টাকা থাকলে সব ধরনের অপরাধ করেও আদালতে জামিন পাওয়া যায়-সমাজে এমন একটা বাজে বার্তা যাচ্ছে। এটি খুবই ভীতিকর।

সূত্র বলছে, চাঞ্চল্যকর ট্রিপল মার্ডার ও ডাবল মার্ডার মামলার অধিকাংশ আসামি এক মাসের মধ্যে জামিন পেয়েছেন। আবার অনেকের জামিন মিলেছে দিনে দিনেই। নিজ হেফাজত থেকে অস্ত্র উদ্ধারসহ থানায় হওয়া বেশ কয়েকটি মামলার প্রায় সব আসামিই এক থেকে দুই মাসের মধ্যে জামিন পেয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশে সহজেই জামিনে মুক্তি পাচ্ছেন অপরাধীরা। সরকারি পাবলিক প্রসিকিউটর খন্দকার সিরাজুল ইসলামসহ কয়েকজন আইনজীবী জামিনের শক্তিশালী সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে জামিন বাণিজ্যেরও ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন পিপি সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমি পিপি হিসাবে সব মামলায় হার্ডলি বাধা দিই। এরপরও যদি বিচারক পজিটিভলি কনভেন্স হয়ে জামিন দেন, সেক্ষেত্রে কিছু বলার নেই। তিনি বলেন, এখানে অনেকেই পিপি হতে চেয়েছিল। কিন্তু হতে পারেনি। তারাই আমার বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে।

নিহতের পরিবার, পুলিশ ও আদালত সূত্রের তথ্যমতে, ২০২৪ সালের ৩০ অক্টোবর দৌলতপুরের সাতারপাড়া বাজারে সামাজিক দ্বন্দ্বে প্রকাশ্যে আপন দুই ভাই হামিদ ও নজরুলকে কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষের লোকজন। এ ঘটনায় ২ নভেম্বর ৪৭ জনের নাম উল্লেখ করে থানায় মামলা হয়। এ মামলার এক আসামি পলাতক রয়েছেন। বাকিরা আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন। এর মধ্যে ২০ আসামিকে জেলেই যেতে হয়নি। এদের জামিন মঞ্জুর করেন কুষ্টিয়া জেলা ও দায়রা জজ আদালত।

banner

মামলার বাদী সুরুজ আলী বলেন, হত্যায় জড়িতদের জামিনে আমরা অসন্তুষ্ট ও চরমভাবে হতাশ। আমাদের বঞ্চিত করে আসামিদের পক্ষে কাজ করছে সবাই। তা না হলে, এমন খুনিদের জামিন হয় কীভাবে? আমরা কি এই হত্যার নিরপেক্ষ বিচার পাব না? তিনি আরও বলেন, আসামিরা জামিনে বেরিয়ে এসে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। তারা আমাদের ক্ষতি করার ও ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন। এমন আরও কয়েকটি হত্যা ও অস্ত্র মামলার বেশ কয়েকজন আসামিকে জামিন দিয়েছেন আদালত।

গত ১০ জুন রাতে ইবি থানার মধুপুর পশু বাজারের পাশে আশরাফুল আলম টুটুলকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় মামলা হলে আসামি চরমপন্থি রাজু আহমেদকে ২৩ জুন রাতে গ্রেফতার করে পুলিশ। দেড় মাসের মাথায় ১২ আগস্ট কুষ্টিয়ার জেলা ও দায়রা জজ আদালত থেকে জামিন পান তিনি। এ মামলার আরেক আসামি মিলনকে ১২ জুলাই গ্রেফতার করে র‌্যাব। তাকেও এক মাস পর ১২ আগস্ট জামিন দেওয়া হয়।

২০২৩ সালের ২৭ এপ্রিল দৌলতপুরের চিলমারীতে মন্ডল গ্রুপের লোকজনের পাঁচটি বাড়িতে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় খাঁ ও শিকদার গ্রুপের লোকজন। এতে দগ্ধ হয়ে দিনু মন্ডল, ফারুক ও আকতার মন্ডল নামে তিনজন মারা যান। দগ্ধ হন আরও ২৫ জন। এ ঘটনায় মোজাম মন্ডল বাদী হয়ে মামলা করেন। এ মামলায় আলমগীর শিকদার নামে একজন জেলে এবং ৮ জন পলাতক রয়েছেন। বাকি সব আসামিকে জামিন দিয়েছেন আদালত। এমনকি এ হত্যা মামলার প্রধান আসামি শেলী দেওয়ানকে একদিনের জন্যও জেলে যেতে হয়নি। গ্রেফতারের দিনই তাকে অসুস্থ ও বয়স্ক দেখিয়ে জামিন মঞ্জুর করেন চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। এ মামলার আরও ১৪ আসামিকে গ্রেফতারের মাত্র দুদিনের মাথায় জামিন মঞ্জুর করেন আদালত।

নিহতের পরিবারের সদস্যরা বলেন, এ ঘটনায় আদালতে ১১৯ জনের বিরুদ্ধে এবং দৌলতপুর থানায় ৭১ জনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়। মামলা দুটি সমন্বয় করে ৯৪ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় পুলিশ। মোজাম মন্ডল বলেন, আমরা নিরপেক্ষ বিচার ও তদন্ত পাইনি। জামিনে বের হয়ে আসামিরা বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। সবাই আসামিদের পক্ষে কাজ করছে। এসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ করার সাহস আমাদের নেই। গত ৯ জুলাই ভোরে ভেড়ামারা উপজেলার উত্তর ভবানীপুর এলাকার নিজ বাড়ি থেকে আগ্নেয়াস্ত্র, কার্তুজ ও রামদাসহ আটক হন দাউদ হোসেন। এক মাসের মাথায় ১১ আগস্ট তাকে জামিন দেন জেলা ও দায়রা জেলা জজ আদালত।

গত ২৫ মার্চ খোকসার ওসমানপুর গ্রামে শহিদুল ইসলামের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে বিদেশি রিভলবার, ৫টি গুলি ও দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত ওসমানপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সভাপতি শহিদুল ইসলাম, তার ভাই জিল্লুর রহমান ও ছেলে জুবায়ের ইসলাম জ্যাকিকে আটক করে। ২০ দিন পর জ্যাকি ও জিল্লুকে জামিন দেন জেলা জজ আদালত। আরেক আসামি শহিদুল ইসলামকে এক মাস ৫ দিন পর ৩০ এপ্রিল জামিন দেন একই আদালত। গত ৩১ মার্চ বিকালে মিরপুরের কাকিলাদহ গ্রামে হাবিবুর রহমানের নিজ হেফাজত থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, ৫ রাউন্ড গুলি ও ম্যাগাজিন উদ্ধার করে পুলিশ। সঙ্গে থাকা আরও চারজনকে গ্রেফতার করে। এ মামলার প্রধান আসামি হাবিব ৪ জুন জেলা জজ আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন। এর আগে অন্য আসামিদেরও জামিন দেওয়া হয়। কয়েকজন আইনজীবী বলেন, পিপি খন্দকার সিরাজুল ইসলামসহ আরও কয়েকজন আইনজীবী কুষ্টিয়া আদালতে জামিনের একটি সিন্ডিকেট তৈরি করে মোটা অঙ্কের অর্থ বাণিজ্য করছেন। সিন্ডিকেটে জড়িত আইনজীবীদের আসামিদের খুব সহজেই জামিন মিলছে। এখানে অপরাধ বিচার করা হচ্ছে না। কিন্তু সিন্ডিকেটের বাইরের আইনজীবীরা মাসের পর মাস ঘুরেও তাদের আসামিদের জামিন করাতে পারছেন না। বিষয়গুলো তদন্ত করলে অনিয়ম-দুর্নীতি ধরা পড়বে। কুষ্টিয়া জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সেরেস্তাদার আজম আলী বলেন, এসব আসামি অনেকেই হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে এসেছিল। মামলাগুলো বেশ কিছুদিন আগের। অফিসে এলে বিস্তারিত বলতে পারব।

“সুত্র: দৈনিক যুগান্তর”

এই সম্পর্কিত আরো পোস্ট দেখতে পারেন

কমেন্ট লিখুন