সুনামগঞ্জ সংবাদদাতা:
সরল ভাষায় মনের কথা তুলে আনতে আজও তাঁর জুড়ি মেলা ভার। তাঁর গানের সুর ও কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতো টানে মানুষকে। আর এভাবে তিনি কোটি মানুষের হৃদয়ে অবিনাশী জায়গা করে নিয়েছেন। যাপন করে গেছেন চরম দরিদ্রতা, বঞ্চনার জীবন। তবুও ছিলেন নির্মোহ; মানুষের ভালোবাসা ছাড়া আর কোনো লোভ ছিল না তাঁর। স্বভাবে সরল ও বিনম্র এ বাউল সাধক পার করে গেছেন মহাজীবন, যার অবসান হয় ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর।
কথা হচ্ছিল ভাটি অঞ্চল সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে জন্ম নেওয়া কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী, সুরকার ও গীতিকার শাহ আবদুল করিমকে নিয়ে। বাংলা গানের সুরের আঙিনায় তিনি চির অমলিন এক নাম। তাঁর গানে কেবল সুরের জাদুই ছিল না, ছিল জীবনের গভীরতার স্পর্শও। মানুষের প্রতি অশেষ ভালোবাসা ও মানবতার আলোকশিখা ছিল শাহ আবদুল করিমের রচনায়।
শুক্রবার সন্ধ্যায় ধানমন্ডির ছায়ানট মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় ‘ছায়ানটের শ্রোতার আসরের বিশেষ আয়োজন: বাউল সাধক শাহ আবদুল করিম স্মরণে সংগীতানুষ্ঠান’। আসরের কথন উপস্থাপন করেন ছায়ানটের সভাপতি সারওয়ার আলী। তিনি বলেন, বাউল সাধকদের আধ্যাত্মিকতায় সৃষ্টিকর্তা শাসনে নয়, অন্তরে স্থান পায়, যা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের মধ্যে দেখা যায়। কিন্তু শাহ আবদুল করিম এদিক থেকে এক পা এগিয়ে। শাহ আবদুল করিম একমাত্র বাউল সাধক, যিনি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ওপর গান রচনা করেছেন ও গেয়েছেন। তিনি একজন সমাজ-সচেতন বাউল সাধক ছিলেন। তাঁর গানগুলো সারাদেশের মানুষকে সম্প্রীতির বাঁধনে আবদ্ধ করে।
এর পর মঞ্চ ভরে ওঠে গানের সমারোহে। আবহমান বাংলার আকাশ-পাতাল ভরিয়ে দেওয়া সুর যেন নতুন প্রাণ পেল শিল্পীদের কণ্ঠে। সংগীত পরিবেশনার শুরুতে ফারজানা আফরিন ইভা কণ্ঠে তুললেন– ‘প্রাণনাথ ছাড়িয়া যাইয়ো না’ এবং ‘তোমার পিরিতে বন্ধু গো’। শ্রোতারা যেন ডুবে গেলেন অতল ব্যথার নদীতে।
এর পর মঞ্চে আসেন সোহেল রানা। তিনি গাইলেন– ‘মন মিলে মানুষ মিলে সময় মিলে না’ ও ‘জীবন আমার ধন্য যে হায়’। গান দুটি দর্শকসারিতে এনে দেয় সাড়া জাগানো আবেশ।
বিমান চন্দ্র বিশ্বাস গাইলেন– ‘কেন পিরিতি বাড়াইলি’ ও ‘ভাব-সাগরের নাইয়া’। দুই গানেই প্রেম, বিরহ আর দার্শনিক উপলব্ধির অনুরণন ভেসে আসে। আবুল কালাম আজাদ শ্রোতাদের আবিষ্ট করেন ‘মন মজালে ওরে বাউলা গান’ এবং ‘আগের বাহাদুরি এখন গেল কই’ গেয়ে।
চন্দনা মজুমদার পরিবেশন করেন তিনটি গান– ‘কুলমান সঁপিলাম তোমারে’, ‘তুমি বিনে আকুল পরান’ এবং ‘আমার প্রাণ কান্দে’।
বাংলার লোকসংগীতের আঙিনায় শাহ আবদুল করিমের গান আজও সমান প্রাসঙ্গিক ও প্রাণবন্ত। শ্রোতা ও দর্শনার্থীরা মনে করেন, ছায়ানটের এ আয়োজন তাই কেবল স্মরণানুষ্ঠান নয়, বরং ছিল এক নতুন করে জীবন ও মানবতার গান শোনার আয়োজন। পুরো আয়োজনের নেপথ্য পাঠ ও সঞ্চালনায় ছিলেন জয়ন্ত রায়। তাঁর সাবলীল উপস্থাপনায় অনুষ্ঠান পায় এক অনন্য মাধুর্য।