Table of Contents
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ গতকাল বুধবার সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে বিচার শুরু হয়।
বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। এ সময় তিনি আবু সাঈদকে জুলাই আন্দোলনের ‘ফিনিক্স পাখি’ এবং জুলাই শহীদদের ‘অগ্রসেনানী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারক মো. মঞ্জুরুল বাছিদ ও বিচারক নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার কবীর। আজ বৃহস্পতিবার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হবে।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মো. হাসিবুর রশীদসহ ৩০ জনকে এ মামলায় আসামি করা হয়েছে। সাবেক উপাচার্যসহ ২৪ জন আসামি পলাতক। অন্য ছয় আসামি কারাগারে আছেন। তাঁরা হলেন রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম, সাবেক সহকারী রেজিস্ট্রার রাফিউল হাসান, রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের চুক্তিভিত্তিক সাবেক কর্মচারী আনোয়ার পারভেজ, পুলিশের সাবেক সহকারী উপপরিদর্শক আমির হোসেন, সাবেক কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায় এবং নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা ইমরান চৌধুরী ওরফে আকাশ। গতকাল তাঁদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।
গত বছরের ১৬ জুলাই রংপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। তাঁকে হত্যার ভিডিও সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি করে। ভিডিওতে দেখা যায়, আবু সাঈদ দুই হাত প্রসারিত করে সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন আর পুলিশ তাঁর বুকে একের পর এক গুলি করছে। এ হত্যাকাণ্ড আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় এবং সারা দেশে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় গত ২৪ জুন ৩০ জনকে আসামি করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। পরে ৬ আগস্ট আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল।
আবু সাঈদের মামলা ছাড়া গণ-অভ্যুত্থানের ঘটনায় আরও দুটি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আনুষ্ঠানিক বিচার চলছে। এর মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে একটি মামলায় ২৯ জন সাক্ষী জবানবন্দি দিয়েছেন। রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অপর মামলায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। এখন পর্যন্ত এ মামলায় ৮ জন সাক্ষী জবানবন্দি দিয়েছেন।
সূচনা বক্তব্যে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, গত বছরের ১৬ জুলাই রংপুর নগরীর লালবাগ এলাকা থেকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে বিক্ষোভ মিছিল এগিয়ে এলে অসংখ্য সশস্ত্র পুলিশ রাজপথে শিক্ষার্থীদের বাধা দেন। একপর্যায়ে রংপুর মহানগর পুলিশের (আরপিএমপি) সাবেক সহকারী কমিশনার মো. আরিফুজ্জামানের নেতৃত্বে পুলিশের পাঁচ সদস্য স্টিল ও কাঠের লাঠি দিয়ে আবু সাঈদের মাথায় আঘাত করেন এবং তাঁর মাথা দিয়ে রক্ত বের হয়।
সেদিন দুপুরে পুলিশের সাবেক এএসআই আমির হোসেন প্রথমে আবু সাঈদকে গুলি করেন উল্লেখ করে তাজুল ইসলাম বলেন, প্রথম গুলিটি যখন আবু সাঈদের পেটে লাগে, তখন তিনি হতবাক হয়ে যান এবং আবার বুক প্রসারিত করে সেখানে দাঁড়িয়ে যান। সে সময় সাবেক কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায় তাঁকে পরপর দুটি গুলি করেন। এতে আবু সাঈদ সড়ক বিভাজক পার হয়ে বসে পড়েন। আবু সাঈদকে আনতে গিয়ে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাওহিদুর হকের শরীরে প্রায় ৬০টি ছররা গুলি লাগে। হাসপাতালে নেওয়ার পথে সহযোদ্ধাদের বাহুডোরে আবু সাঈদ মারা যান।
‘ইচ্ছাকৃত অনুপস্থিতি কিংবা বিদেশে আশ্রয়’
আবু সাঈদের মামলায় যে ২৪ জন পলাতক রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাবেক উপাচার্য হাসিবুর রশীদ, সাবেক সহযোগী অধ্যাপক মশিউর রহমান, সাবেক সহযোগী অধ্যাপক আসাদুজ্জামান মণ্ডল, চিকিৎসক সরোয়ার হোসেন (চন্দন), আরপিএমপির সাবেক কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান, সাবেক উপকমিশনার আবু মারুফ হোসেন, সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ নূর আলম পাটোয়ারী, সাবেক সহকারী কমিশনার মো. আরিফুজ্জামান, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি পোমেল বড়ুয়া, সাধারণ সম্পাদক মো. মাহাফুজুর রহমান প্রমুখ।
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, ২৪ আসামির ইচ্ছাকৃত অনুপস্থিতি কিংবা বিদেশে আশ্রয় নেওয়ার ফলে বিচারপ্রক্রিয়া থেমে থাকলে তা ন্যায়বিচারের পরিপন্থী হতো। আসামির অনুপস্থিতিতে বিচার কার্যক্রম চললেও তা ন্যায়বিচার থেকে বিচ্যুতি নয়। আইনের যথাযথ বিধান অনুসরণ করেই এই ট্রাইব্যুনাল অনুপস্থিত আসামিদের বিরুদ্ধেও রায় দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা রাখে।
হাসিনার সঙ্গে ঢাবি উপাচার্যের আলাপ
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে আগে থেকেই ছাত্র-জনতার ওপর সরাসরি গুলির নির্দেশ দিয়েছিলেন, তা জানা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামালের সঙ্গে তাঁর (হাসিনা) টেলিফোন কথোপকথন থেকে। শেখ হাসিনা ও মাকসুদ কামালের সেই টেলিফোন কথোপকথন ট্রাইব্যুনালকে পড়ে শোনান চিফ প্রসিকিউটর।
টেলিফোনে শেখ হাসিনা বলেন, ‘কোন দেশে বাস করি আমরা। এদেরকে বাড়তে বাড়তে তো…রাজাকারদের কী অবস্থা হয়েছে দেখিস নাই, সবগুলাকে ফাঁসি দিছি, এবার তোদেরও ছাড়ব না।’ তখন মাকসুদ কামাল বলেন, ‘হ্যাঁ, এবার এই ঝামেলাটা যাক, এরপরে আমিও নিজে ধরে ধরে যারা এই অস্থিরতা সৃষ্টি করছে, মেইন যারা আছে এদেরকে বহিষ্কার করব ইউনিভার্সিটি থেকে।’
এরপর শেখ হাসিনা বলেন, ‘সব এইগুলাকে বাইর করে দিতে হবে………আমি বলে দিচ্ছি আজকে সহ্য করার পরে অ্যারেস্ট (গ্রেপ্তার) করবে, ধরে নেবে এবং যা অ্যাকশন নেওয়ার নেবে………ইংল্যান্ডে এ রকম ছাত্ররাজনীতির জন্য মাঠে নামলে, কতগুলি মেরে ফেলায় দিলো না?’
মাকসুদ কামাল বলেন, ‘জি জি জি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘অ্যাকশন না নেওয়া ছাড়া উপায় নাই। আমরা এত বেশি সহনশীলতা দেখাই……আজ এত দূর পর্যন্ত আসছে।’
‘ফ্যাসিস্টদের তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন শেখ হাসিনা’
যুগে যুগে স্বৈরশাসকের আবির্ভাব হয়েছে এবং দেশে দেশে ফ্যাসিস্টদের জন্ম হয়েছে উল্লেখ করে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘ফ্যাসিস্টদের তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন শেখ হাসিনা। আমরা তাঁর দোসরদের বিরুদ্ধেই আজ আপনাদের কাছে ন্যায়বিচার চাচ্ছি।’
তাজুল ইসলাম বলেন, ‘নীলনকশার নির্বাচন, লাইলাতুল ইলেকশন আর আমি-ডামির নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার মসনদ আঁকড়ে ধরে বিগত ১৭ বছরে বাংলাদেশের মাটিতে খুন, গুম, রাজনৈতিক নিপীড়নের যে কালচার চালু হয়েছিল, আজ তার বিচারের ফরিয়াদি আমরা। আর আপনারা তার বিচারক। আমরা চাই এই বিচার জাতির সভ্যতার সোপানে ন্যায়বিচারের মানদণ্ড হিসেবে স্থান পাক; যাতে আগামীর বাংলাদেশে কেউ গণহত্যা চালাতে না পারে।’
পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক স্বৈরাচার পালিয়ে গেছে উল্লেখ করে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশে দেখেছি স্বৈরাচার পালিয়েই শুধু যায়নি, তার ৩০০ এমপি, তার কেবিনেট, মসজিদের ইমাম থেকে শুরু করে সেই সকল বিচারক যারা নিজেদের শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ বলে দাবি করত, তারাও পালিয়েছে।’
এই বিচার কার্যক্রম পুরোনো রাজনৈতিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য নয়, বরং একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে রাষ্ট্র একটি ন্যায়সংগত ও দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে বলেও বক্তব্যে উল্লেখ করেন তাজুল ইসলাম।
পুলিশের দুই সদস্য কারাগারে
গণ-অভ্যুত্থানের সময় ময়মনসিংহের গৌরীপুরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের আরেকটি মামলায় পুলিশের দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দুই পুলিশ সদস্য হলেন সাবেক উপপরিদর্শক শফিকুল আলম ও সহকারী উপপরিদর্শক দেলোয়ার হোসেন।
এই দুই আসামি আগে থেকে অন্য মামলায় গ্রেপ্তার ছিলেন। গতকাল তাঁদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। প্রসিকিউটর আবদুস সাত্তার তাঁদের এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর আবেদন করলে তা মঞ্জুর করেন ট্রাইব্যুনাল। এ মামলায় আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য করা হয়েছে।
“সুত্র: দৈনিক প্রথম আলো”