Home » অস্থিরতার আবর্তে রাজনীতি

অস্থিরতার আবর্তে রাজনীতি

0 মন্তব্য গুলি 2 জন দেখেছে 6 মিনিট পড়েছেন
  • নির্বাচন ঝুলে গেলে ভয়ানক অনিশ্চয়তা দেখা দেবে : অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী
  • ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হলে জাতীয় নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হবে : অধ্যাপক আলী রীয়াজ
  • চার দফা দাবিতে আন্দোলনে যাচ্ছে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ ৭টি দল

প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুসারে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর পাঁচ মাস বাকি। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে জনমনে এখনো অনিশ্চয়তা কাটেনি। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে—ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হবে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস গত বৃহস্পতিবার বলেছেন, ‘ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের কোনো বিকল্প আমাদের হাতে নেই।

’ গতকাল শনিবার এক গোলটেবিল বৈঠকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন না হলে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা তৈরি হওয়ার পাশাপাশি জাতীয় নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হবে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য একই অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘দর্শক নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত, কিন্তু মঞ্চ তো প্রস্তুত না। মঞ্চের নায়ক-নায়িকারাও তাঁদের ভূমিকা সম্পর্কে প্রস্তুত না। দর্শকদের আর ধৈর্যচ্যুতি ঘটাবেন না।

’ সংস্কার বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘যেটুকু সম্ভব সেটুকুর বাইরে যেগুলো অসম্ভব সেগুলো আকাঙ্ক্ষা হিসেবে থাকতে পারে। এই বাস্তববাদিতা থাকা দরকার।’ সংবিধান নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া করলে আরো গভীর সাংবিধানিক বিষয় সামনে চলে আসতে পারে বলেও তিনি আশঙ্কা ব্যক্ত করেন।

এদিকে এরই মধ্যে দেশের রাজনীতিতে রাষ্ট্রের সংস্কার নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য জটিল আকার ধারণ করেছে বলে জনপরিসরে আলোচনা হচ্ছে।

banner

এই বিষয়সহ নির্বাচনকেন্দ্রিক চার দফা দাবিতে যুগপৎ কর্মসূচিতে যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামীসহ সাতটি দল। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এ আন্দোলনে যুক্ত থাকবে বলে প্রচার পেলেও দলটি তা অস্বীকার করেছে।

সম্প্রতি ডাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের ভূমিধস বিজয়ের পর জাতীয় রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামীর প্রভাব নিয়ে এখন নানা বিশ্লেষণ চলমান। দেশের বাইরে থেকেও দুই রকম প্রতিক্রিয়া মিলেছে। ছাত্রশিবিরের সাফল্যকে অভিনন্দন জানিয়ে পাকিস্তান জামায়াতের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এই সাফল্য বাংলাদেশে নির্মাণ ও উন্নয়নের এক নতুন যুগের সূচনা প্রমাণ করবে, জাতীয় জীবন ও গণতন্ত্রে ছাত্র ও যুবকদের ভূমিকার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরবে এবং ভারতীয় ষড়যন্ত্র থেকে মুক্তির পথে অগ্রসর হবে।

ইনশাআল্লাহ।’ অন্যদিকে ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা গত বৃহস্পতিবার দিল্লিতে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে এক আলোচনাসভায় বলেছেন, জামায়াতে ইসলামীর হাতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের রক্ত লেগে আছে। এই চিতাবাঘ (জামায়াত) তার দাগ বদলাবে না। ক্ষমতায় এসে কেউ ভারতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করলে এ নিয়ে ভারতকে চিন্তিত হতে হবে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টও সম্প্রতি নেপাল ও বাংলাদেশে তরুণ প্রজন্মের আন্দোলনে সরকার পতনের প্রসঙ্গ টেনে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারকে সতর্ক করে দিয়েছেন। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বুধবার আদালতে এক শুনানির সময় তাদের প্রতিবেশী এ দুই দেশের প্রসঙ্গে কথা বলেছেন ভারতের প্রধান বিচারপতি বি আর গাভাই ও বিচারপতি বিক্রম নাথ।

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের রাজনীতি এখন অস্থির আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। কোনো একটি দেশের সংকট মোকাবেলায় রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে ভূমিকা রাখতে হয়। কিন্তু দেশে এখন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্যই প্রবল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশে যখন একটা সংকট হয়, তখন সব রাজনৈতিক শক্তি একত্র হয়ে সেই সংকট থেকে উত্তরণের চেষ্টা করে। নেপালে যে ঘটনা ঘটল, আমরা জানলাম, সেখানে দ্রুত একজনকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং তিন-চারজনের একটি মন্ত্রিসভা গঠন করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে—ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন হবে। সে দেশের জনগণ এতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। কিন্তু আমাদের এখানে তেমনটা হয়নি। আমাদের রাজনৈতিক শক্তিগুলো কোনো বিষয়েই তো একমত হতে পারছে না। তারা যদি একমত না হয় তাহলে নির্বাচন ঝুলে যাবে এবং দেশে ভয়ানক অনিশ্চয়তা দেখা দেবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ নির্বাচন নিয়ে যা ঘটল তা ভালো লক্ষণ নয়।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো কোনো দিনই জনগণের জন্য রাজনীতি করেনি। তারা সব সময় রাজনীতি করেছে নিজেদের আখের গোছানোর জন্য। সে কারণেই দেশের এত বড় সংকটেও তারা একমত হতে পারছে না।’

পকিস্তান জামায়াতের অভিনন্দন এবং ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার মন্তব্য সম্পর্কে অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ শুরু থেকে হয়ে আসছে। জনগণ নয়, দুর্ভাগ্যজনকভাবে বহিঃশক্তিই আমাদের চালিকাশক্তি। ভারত ও পাকিস্তান—তারা উভয়ের চিরশত্রু। তাদের এ ধরনের অবস্থানে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। ভারত চাইবে তাদের পছন্দের সরকার আসুক, আর পাকিস্তান চাইবে ভারতবিরোধী সরকার আসুক।’

যে চার দাবিতে যুগপৎ আন্দোলন হতে যাচ্ছে : সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, চার দফা দাবিতে জামায়াতে ইসলামী, চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, মাওলানা মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, মাওলানা আবদুল বাছিত আজাদ ও আহমদ আবদুল কাদেরের নেতৃত্বাধীন খেলাফত মজলিস, নুরুল হকের নেতৃত্বাধীন গণ অধিকার পরিষদ, মুজিবুর রহমান মনজুর নেতৃত্বাধীন আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি ও সরওয়ার কামাল আজিজীর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচি দিতে যাচ্ছে। শিগগির পৃথক সংবাদ সম্মেলন করে দলগুলো কর্মসূচি ঘোষণা করবে। দলগুলোর দাবি হচ্ছে—জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়নসহ এর ভিত্তিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে (পিআর) জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান, নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড (সবার জন্য সমান সুযোগ) তৈরি করা এবং ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে জাতীয় পার্টি (জাপা) ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা। আগামী সোমবার দলের পক্ষ থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করবে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। গতকাল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম (চরমোনাই পীর) এক বিবৃতিতে এ কথা জানান। তিনি বলেন, ‘এত রক্ত ও জীবনের বিনিময়ে অর্জিত জুলাইয়ের সনদ নিয়ে নয়ছয় করা হচ্ছে। পুরনো বন্দোবস্তে নির্বাচন আয়োজনের তোড়জোড় চলছে। সামগ্রিকভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে যে জুলাইয়ের আত্মত্যাগ ম্রিয়মাণ হতে চলছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এটা হতে দিতে পারে না। জুলাইয়ে হাসিনার বিরুদ্ধে যে সাহসিকতা ও ঝুঁকি নিয়ে নেমেছিলাম সেই প্রতিজ্ঞায় আবারও মাঠে অবস্থান নেবে ইসলামী আন্দোলন।’ জামায়াতে ইসলামী ও বলে আসছে, ভোটের আগে সংস্কার ও পিআর পদ্ধতি মানতে বাধ্য করা হবে।

এদিকে জুলাই সনদ নিয়ে বিএনপি ও তাদের মিত্রদলগুলো, ১২ দলীয় জোট এবং বাম সংগঠনগুলোর ভিন্নমত রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে যে প্রস্তাবগুলো এসেছে, সাধারণভাবে সেগুলো অগ্রহণযোগ্য এবং যৌক্তিক নয়। তিনি আরো বলেন, আলোচনার মাধ্যমে একটা জায়গায় যেতে পারলে বিএনপি সবচেয়ে খুশি হবে। কারণ এই অনিশ্চয়তা বেশিদিন অব্যাহত রাখা যাবে না।

প্রসঙ্গত, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদের সাংবিধানিক সংস্কারের দিকগুলো গণভোট ও বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়নের সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল চায়, আগামী নির্বাচনের পর জাতীয় সংসদে এগুলো বাস্তবায়ন হোক।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক মনে করেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করবে আগামী জাতীয় সংসদ। কারণ সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও বিদ্যমান সংবিধানের আলোকেই আমরা চলছি। সনদ বাস্তবায়নে রাষ্ট্রপতির আদেশ হলে তা বিপজ্জনক হবে।’

সাইফুল হক দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত খারাপ হচ্ছে। মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে। প্রধান উপদেষ্টা নিজেও উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। সরকারপ্রধান স্বয়ং যখন নির্বাচন বানচালের আশঙ্কা ব্যক্ত করেন, তখন বোঝা যায় যে পরিস্থিতি ভালো নয়। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন যদি ভণ্ডুল বা স্থগিত হয়ে যায়, তাহলে দেশে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হবে। এতে সারা দেশে হানাহানি ও সংঘাত ছড়িয়ে পড়বে। এখন সামাজিক নৈরাজ্য চলছে, যা রাজনৈতিক নৈরাজ্যে রূপ নিতে পারে, যার প্রভাবে দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা বিপর্যস্ত হবে। তিনি বলেন, অভ্যুত্থানকারী দলগুলোর মধ্যে নানা প্রশ্নে প্রতিদিন বিভক্তি-বিভাজন বাড়ছে; যে কারণে ঈশান কোণে ঝড়ের আভাস দেখতে পাচ্ছি। দলীয় নানা এজেন্ডা হাজির করে যারা দেশে একটা অচলাবস্থা সৃষ্টি করতে চায়, তারা আসলে দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণকে বিপদগ্রস্ত করে তুলছে। এই পরিস্থিতি পুরনো ফ্যাসিবাদী জামানাকে ডেকে আনতে পারে। এই অবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের দৃঢ়চিত্ত ভূমিকা রাখতে হবে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলসহ সবাইকে আস্থার মধ্যে নিতে হবে।

তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ গভীর নিরাপত্তাঝুঁকিতে আছে। দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র চলছে। শুধু নির্বাচন নয়, অস্থিরতার মধ্য দিয়ে দেশের পুরো অর্জন শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ বিষয়ে সরকার, রাজনৈতিক দল ও দেশবাসীকে সতর্ক হতে হবে।

“সুত্র: দৈনিক কালেরকন্ঠ”

এই সম্পর্কিত আরো পোস্ট দেখতে পারেন

কমেন্ট লিখুন