দীপক কুমার কর
পরিবেশবাদী ও গণমাধ্যম কর্মী
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস স্থাপন এখন সময়ের দাবি। এই সময়োচিত ও নায্য দাবি আদায়ে লাগাতার আন্দোলন করছেন ছাত্র-ছাত্রীরা। তাদের আন্দোলনকে সম্মান জানিয়ে অনতিবিলম্বে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিৎ বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থায়ী ক্যাম্পাস স্থাপনের কাজ শুরু করা। তবে তা স্থাপনে ভৌগলিক, পারিপার্শ্বিক, পরিবেশ, প্রতিবেশ ও চলমান উন্নয়নসহ বাণিজ্য- বিপনন ক্ষেত্রে যেন কোন বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়, সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা, বিচক্ষণতা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া অপরিহার্য বলে আমরা মনে করি।
ইতিপুর্বেই স্বল্প পরিসরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। তাকে পুর্নাঙ্গ কলেবরে স্থায়ী রূপ দেওয়াই এখন সকলের প্রাণের দাবি।
আমরা জানি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে কবিগুরুর দান-অবদানের কিঁঞ্চিৎ ইতিহাস। তিনি শাহজাদপুরের রাউতারা পোতাজিয়া এলাকায় ( চলনবিল, চলনবিলের বড়াল ও গোহালা নদীর অববাহিকার তীরবর্তী পাঁথারের) ১৪০০ একর জমি গোচারণ ভূমি হিসাবে দান করেছেন। যার ফলশ্রুতিতে এলাকার গো-খামারীরা উন্নতজাতের গাভী পালন করে দেশের মধ্যে দুধ ও মাংস উৎপাদনে খ্যাতির শীর্ষে অবস্থান করছেন। পাশাপাশি এই উৎপাদনকে কেন্দ্র করে বাঘাবাড়ি মিল্কভিটার মত বিশাল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আর চলনবিল তথা বড়াল ও গোহালা নদীর দানে গড়ে উঠেছে উত্তরবঙ্গের বৃহৎ বাঘাবাড়ি নৌবন্দর। দাতার দান অত্যন্ত মর্যাদার। যে উদ্দেশ্যে দাতা দান করেন তা যথাযথ বাস্তবায়ন করা গ্রহিতার অবশ্য কর্তব্য। কিন্ত আমরা জানতে পারলাম গোচারণ ভূমির ১০০ একর জায়গায় রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠার কাজ করা হবে। রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে তিনি মর্মাহত হতেন।কারণ তিনি দান করেছেন ওটা গোচারণ ভূমি হিসাবে।
সেখানে বড় ধরণের স্থাপনা ও যাতয়াতের জন্য রাস্তা নির্মাণ ও নদী শাসন করে ব্রিজ নির্মাণ করা হলে স্বাভাবিক পানি প্রবাহ রুদ্ধ হবে। বন্ধ হবে চলনবিলের পানি বের হয়ে যমুনায় পতিত হওয়ার একমাত্র পথ। এতে চলনবিলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে প্রাণ সংকটে পড়বে অনন্ত কোটি জলজ প্রাণি উদ্ভিদ, ধ্বংস হবে অপরিসীম জীববৈচিত্র্য, মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে নদী নির্ভর জীবনজীবিকা, ঘটবে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়। যে ক্ষতি আর কোনকালেও পরিপুরণ করা যাবে না।
CEGIS এর গবেষণা জরিপ মতে উত্তরজনপদের ৬ টি জেলা ৪১ টি উপজেলা, ১ হাজার ২০ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট চলনবিলের ৪৭ টি নদী ১৬৩ টি বিল ৩০০ টিরও বেশি ক্যানেল, ১ লাখ ২০ হাজার পুকুর, কয়েকটি বড় বড় পাঁথার, প্রত্যক্ষ পরোক্ষ সুফলভোগী প্রায় ১ কোটি মানুষ। ১০৫ প্রজাতির মাছ, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণি, ৭ প্রকারের উভচর প্রাণি, ৩৬ প্রজাতির পাখি, অসংখ্য প্রকারের জলজ উদ্ভিদ সমৃদ্ধ এই বিশাল জলধি চলনবিল। এই বিল চরম প্রাকৃতিক ও পরিবেশ বিপর্যয়ের শিকার হবে।
অপরদিকে উত্তরবঙ্গের প্রসিদ্ধ বাঘাবাড়ি নৌবন্দর চরম নাব্য সংকটে পড়ে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। বন্ধ হয়ে যেতে পারে অতি অল্প সময়ে সুলভে দেশে গুরুত্বপুর্ণ ভারীপন্য সরবরাহের সুযোগ । যেখান থেকে আসে বার্ষিক রাজস্ব আয় প্রায় ৪ কোটি টাকা। আর সার ও পেট্রোলিয়াম জাতীয় পদার্থসহ প্রায় ৫৭৩ কোটি টাকার পন্য সরবরাহ। বন্ধ হয়ে যেতে পারে এই জনগুরুত্বপুর্ণ বাণিজ্য।
১০০ একর বাদে অবশিষ্ট ১৩০০ একর গোচারণ ভূমি হতে পারে জলাবদ্ধতার শিকার, এতে এলাকার গো- খামারিরা গোখাদ্য সঙ্কটে পড়তে পারে। কমে যেতে পারে দুগ্ধ উৎপাদন। ফলে মিল্ক ভিটায় চলমান উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা রয়েছে। তিন ফসলি চলনবিল জলাবদ্ধতার কারণে হতে পারে এক ফসলি, নৌবন্দর নাব্যতার অভাবে হতে পারে ক্ষতিগ্রস্থ। সৃষ্টি হতে পারে প্রায় দেড়হাজার বর্গকিলোমিটার জুড়ে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়। এরপরও কি বুড়ি পোতাজিয়াতেই বিশ্ব বিদ্যালয়টির স্থায়ী ক্যাম্পাস স্থাপন করা দুরদর্শীতার পরিচায়ক হবে?
মানুষ ব্যাতিত অন্যকোন প্রাণি অপরিণামদর্শী নয়। তাই পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ পরিবেশ বিপর্যয়ের ইতিহাস তার ভয়াবহ সৃষ্টি ।
এমন একটি ঘটনা আরাল সাগরের বিপর্যয় (Aral Sea Disaster, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ১৯৬০-এর দশক থেকে)। সোভিয়েত ইউনিয়ন তুলা চাষ বাড়াতে আরাল সাগরকে পুষ্ট করা দুই নদী আমু দরিয়া ও সির দরিয়া-র পানি বিশাল খাল খনন করে কৃষিক্ষেত্রে সরিয়ে নেয়। এর ফলে কয়েক দশকের মধ্যে আরাল সাগরের আয়তন প্রায় ৯০% কমে যায়।
এক সময়কার বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম হ্রদ মরুভূমিতে পরিণত হয়। মাছের শিল্প ধ্বংস হয়ে যায়, লাখ লাখ মানুষ জীবিকা হারায়। লবণাক্ত ধুলিঝড় পুরো মধ্য এশিয়ার পরিবেশকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
এটি মানবসৃষ্ট সবচেয়ে বড় পরিবেশ বিপর্যয়গুলোর একটি হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত।
আর দেশের শত শত পরিবেশ বিপর্যয়ের ঘটনার মধ্যে স্থানীয় একটি উদাহরণ হলো চলনবিলের বড়াল নদীর অপমৃত্যু! একমাত্র কারণ রাজশাহীর চারঘাটে স্লুইসগেট। যা ঐসময়ে বিশেষজ্ঞরা বিপুল কল্যাণের স্বপ্ন দেখিয়ে ঘটিয়েছিলেন।
এসব ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিৎ নয় কী? কেননা প্রকৃতির উপর অদুরদর্শী হস্তক্ষেপের প্রতিশোধ প্রকৃতি এমন ভয়ানকভাবে নেয় যাতে হয় অবিনাশী ক্ষত। যা কখনোই পরিপুরণ হয় না। আর চলনবিল তো আরাল সাগরের তুলনায় নস্যি। কী ভয়াবহ পরিনতি হতে পারে সে ব্যাপারে এখনই সতর্ক হওয়া অপরিহার্য।
অনেকেরই তো অসীম আগ্রহ দেখছি রবি ঠাকুরের দানের গোচারণ ভূমিতে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার। রবিঠাকুর তো গত হয়েছেন, শাহজাদপুরে জীবিত ব্যক্তিদের মধ্যে একজনও কি দানশীল ব্যক্তি নেই যিনি এমন একটি মহান প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় জমি দান করতে পারেন? অথবা শাহজাদপুরে কী মাটি- জমির এতই আকাল?
আজ যারা পরিবেশ কর্মীদের ব্যাঙ্গ করছেন তাদের জ্ঞাতার্থে বলা দরকার, ১৯১৪ সালে চলনবিলের মধ্য দিয়ে যখন সিরাজগঞ্জ -ঈশ্বরদী রেল লাইন স্থাপিত হয় তখন বৃটিশ বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন “সমস্যা হবে না”। কিন্তু সমস্যা হয়েছে। আসলে চলনবিল মরুক বাঁচুক সেটা বৃটিশদের দেখার বিষয় ছিলনা। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ব্যবসার জন্য দ্রুত পরিবহন ব্যবস্থা তৈরি করা। দেশটা তো তাদের না। কিন্তু এখন তো আমাদের ভাবতে হবে দেশটা আমাদের। প্রতিটি কাজ ভবিষ্যত ভেবে করতে হবে। ইংরেজরা তা করেনি। আর তা করেনি বলে তখন থেকেই স্বাভাবিক পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়ে দ্রুত পলি বালি জমে চলনবিল ভরাট হতে থাকে। এটা ছিল চলনবিলের মৃত্যুর প্রথম ধাপ।
এরপর ২০০৩ সালে যখন হাটিকুমরুল থেকে বনপাড়া মহাসড়ক নির্মাণ করা হলো। তখন আমরা পরিবেশ কর্মীরা বলেছিলাম মাটি ভরাট করে রাস্তা না করে ফ্লাই ওভার করা হোক। তদানিন্তন একজন এমপি আমাদের পাগল আখ্যা দিয়ে গর্ব করে বলেছিলেন “এমন একটা রাস্তা বানালাম মানুষ চিরকাল স্মরণ করবে”।
সত্যি আমরা স্মরণ করছি- মর্মে মর্মে অনুভব করছি এর ভয়াবহ যন্ত্রণা। বর্ষা মৌসুমে মহাসড়কের উত্তর পাশের পানির উচ্চতা প্রায় ৩/৪ ফুট বেশি থাকে। অর্থাৎ পানির প্রবাহ চরমভাবে দ্বিতীয় দফায় বাধাগ্রস্থ হতে শুরু হলো। আরো দ্রুত ভরাট হতে হতে এখন চলনবিল প্রায় কোমায় চলে যাওয়ার উপক্রম। শুকনো মৌসুমে এর এক দশমাংশেও পানি থাকে না। ভরাট হয়ে কমে গেছে পানি ধারণের ক্ষমতা । এমপি সাহেবের কথায় যারা সেদিন সায় দিয়েছিলেন তাদের অনেকেই লজ্জাবনত কন্ঠে এখন স্বীকার করেন সেদিন আমাদের অনুরোধ মোতাবেক ফ্লাই ওভার করলে চলনবিলের আজকের এই ভয়াবহ পরিনতি হতো না। কিন্ত এখন তো আর পাথরে মাথা ঠুকলেও কাজ হবে না।
তেমনি আজকে যারা আমাদেরকে ভুল ভাবছেন। তারা শতভাগ নিশ্চিত থাকুন আমাদের অনুরোধ উপদেশ উপেক্ষা করে যদি বুড়ি পোতাজিয়াতেই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয় তবে চলনবিল, গোচারণভূমি, মিল্কভিটা, নৌবন্দর হারানোর সম্ভবনা প্রায় শতভাগ।
কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াতের জন্য বড়াল নদী শাসন করে বাস্তা নির্মাণ করা হবে। ইতোমধ্যে গোহালা নদী শাসন করে এর গতিমুখ সংকুচিত করে স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয়েছে। মহান স্রষ্টা ভুল করে নদী সৃষ্টি করেছেন আর আমরা তার ভুল সংশোধন করতে স্লুইসগেট স্থাপন করছি। বলা যায় এখানেও শুরু হয়ে গেছে আর একটি সর্বনাশের প্রথম ধাপ।
তাই এই অনুচিত ও অদুরদর্শী সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে পরিবেশের জন্য হুমকি নয় এমন বিকল্প স্থানে অতিদ্রুত রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাস্পাস স্থাপন করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আকুল আবেদন জানাচ্ছি।
চাই রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়! চাই ঝুঁকিমুক্ত পরিবেশ!!